দেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের সুপারিশ
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। দুই ধাপে গঠিত হয় ১১টি সংস্কার কমিশন। প্রথম ধাপে গঠিত ৬টি কমিশনের মধ্যে চারটি সংস্কার কমিশনের প্রধান ও অন্য সদস্যরা গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। এই চার সংস্কার কমিশন হলো সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন।
এ প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনগুলোর দেওয়া প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। আলোচনার ভিত্তিতেই কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নের পথে যাবে সরকার। এর বাস্তবায়ন নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ওপর। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঠিক করা হবে ন্যূনতম সংস্কার, নাকি প্রত্যাশিত মাত্রায় বিস্তৃত সংস্কার করা হবে। আর ন্যূনতম সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য হলে তখন ন্যূনতম সংস্কারের ক্ষেত্রে কোন কোন সুপারিশ প্রাধান্য পাবে, তা চিহ্নিত করা হবে। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পুরো কাজটা অন্তর্বর্তী সরকার সম্পন্ন করে যেতে পারবে বলে আশা এই উপদেষ্টার।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কমিশনগুলোর হস্তান্তর করা সুপারিশের মধ্যে কিছু কিছু কনটেন্ট পুনরাবৃত্তিসহ কিছু সংশোধনী থাকায় কমিশন প্রধানরা আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় চেয়ে নিয়েছেন। তবে কমিশন এ সময়ের আগেই চূড়ান্ত সুপারিশমালা প্রণয়ন করতে পারলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেও শুরু হতে পারে।
সংবিধান সংস্কারে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ও দেশের সাংবিধানিক নাম বদলের সুপারিশ : সংবিধানের সংস্কারে গঠিত কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, দেশের সাংবিধানিক নাম এবং সংসদীয় কাঠামোতে পরিবর্তনের মতো সুপারিশ রয়েছে। এ ছাড়া দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এর মধ্যে একটি হবে নিম্নকক্ষ জাতীয় সংসদ (ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি) এবং আরেকটি উচ্চকক্ষ (সিনেট)। উভয় কক্ষের মেয়াদ হবে চার বছর।
আর একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে দুবারের বেশি হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না। এ ছাড়া সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স কমিয়ে ২১ বছর করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। বর্তমানে জাতীয় সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর। আর সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ রয়েছে ২৫ বছর। একজন ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে কোনো বয়স নির্ধারণ করা নেই।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের কাছে সুপারিশগুলোর বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের যে জন-আকাক্সক্ষা, তার প্রতিফলন হিসেবে আমরা রাষ্ট্রের পাঁচটি মূলনীতি সুপারিশ করছি। সেগুলো হচ্ছে- সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র। বর্তমান বাংলাদেশ সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ রয়েছে। সেই মূলনীতির আলোকে ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত’ করাকে রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে সংবিধানে।
বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের পুনরুদ্ধার বা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা সুপারিশে তুলে ধরার কথা বলেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর প্রস্তাব করার কথা তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, এ দুকক্ষ মিলে যাতে সবার প্রতিনিধিত্ব থাকে, তার জন্য একই সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নিম্নকক্ষ, কিন্তু সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে উচ্চকক্ষ তৈরি করার জন্য সুপারিশ করেছি।
আলী রীয়াজ বলেন, কোনো এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে না পারে, সেজন্য রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ এবং নির্বাহী বিভাগের দুটি পদ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের বিষয় হিসেবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নামে একটি সাংবিধানিক সংস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করেছি। রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা এবং সংসদের দুই কক্ষের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারদের পাশাপাশি অন্যান্য দলের প্রতিনিধিত্বকারী একজনকে এই কাউন্সিলে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
আলী রীয়াজ বলেন, এটা খুব সুস্পষ্ট যে, প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস করার জন্যই এবং যাতে করে তিনি একক ইচ্ছায় নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ করতে না পারেন, সেজন্য আমরা এগুলো জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের কাছে অর্পণ করার সুপারিশ করেছি। প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে সংসদে অনাস্থা ভোটের সুযোগ ফেরানোর অংশ হিসেবে ৭০ অনুচ্ছেদকেন্দ্রিক কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করার কথা বলেন তিনি।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
নির্বাচকম-লীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সুপারিশ করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যে পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে, তাতে ব্যক্তির ইচ্ছা প্রতিফলিত হয় বলে আমরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছি। এক ধরনের নির্বাচকম-লীর মধ্য দিয়ে যেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, আমরা সেই সুপারিশ করেছি।
নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়ে ‘সুস্পষ্ট কাঠামোর’ পরামর্শ প্রতিবেদনে দেওয়ার কথা জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে বাছাইয়ের দায়িত্বভার কোনো ব্যক্তি বা একক প্রতিষ্ঠানের ওপর থাকা ঠিক নয়। সে কারণে আমরা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের কাছে এই বাছাইপ্রক্রিয়া অর্পণ করেছি বা সুপারিশ করেছি। বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের এখতিয়ার ও মর্যাদাসম্পন্ন আদালত স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, সুপ্রিমকোর্টের একক চরিত্র অক্ষুণœ রেখেই দেশের সব বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বিভাগের এখতিয়ার এবং মর্যাদাসম্পন্ন একটি স্থায়ী আসনের সুপারিশ করেছি। ‘শক্তিশালী’ স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে ‘সমন্বয় কাউন্সিল’ গঠনের সুপারিশ করার কথা জানান তিনি।
রাজনীতি ও আমলানির্ভরতা কমিয়ে দুদককে শক্তিশালী করতে ৪৭ সুপারিশ : ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সংবিধানের অঙ্গীকার, দুর্নীতিবিরোধী কৌশলপত্র প্রণয়ন, ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা ও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল, রাজনীতি ও আমলানির্ভরতা কমিয়ে দুদককে শক্তিশালী করতে ৪৭ দফা সুপারিশ করেছে দুদক সংস্কার কমিশন।
দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান কোনো দেশেই এবং বাংলাদেশেও এককভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তার উপরে কেন্দ্রীয় দায়িত্ব নীতিনির্ধারণের; কিন্তু তার জন্য উপযুক্ত রাষ্ট্র এবং সামাজিক পরিবেশ লাগে। পুরো রাষ্ট্র এবং সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হয় এর অবকাঠামোতে। সেই বিবেচনায় আমরা আমাদের সংবিধানের ২০-এর ২ অনুচ্ছেদে যেটা আছে সেটার সংশোধন করতে চাই। সেটা হচ্ছে, সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সংবিধানের একটা অঙ্গীকার।
দুর্নীতিবিরোধী কৌশলপত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোনো জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী কৌশল নাই। কোনো নীতিমালা নাই। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে সুপারিশ করছি, কৌশলপত্র প্রণয়ন করতে হবে। যার মধ্যে রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক কাঠামোতে দুর্নীতিবিরোধী শুধু প্রত্যয়ই না, সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যে অঙ্গীকারগুলে দরকার, দায়িত্ব এবং কর্তব্য সেটি নির্ধারণ করা।
দুনীতিবিরোধী কৌশল প্রতিপালিত হচ্ছে কী না, সেটি পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়নের জন্য সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ন্যায়পালের গুরুত্ব তুলে ধরেন এই সংস্কার কমিশনের প্রধান। তিনি বলেন, ন্যায়পালের একটা কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা, যাদের দায়িত্ব হবে এই কৌশলের বাস্তবায়ন বা প্রতিফলনের মূল্যায়ন করা। দুর্নীতি রুখতে কালো টাকা সাদা করার বৈধতা স্থায়ীভাবে বন্ধ করার সুপাশির করেছেন ইফতেখারুজ্জামান।
নির্বাচনব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে ১৫০ সুপারিশ : নির্বাচনব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার পাশাপাশি সব অংশীজনকে দায়বদ্ধতার মধ্যে আনার লক্ষ্যে প্রায় ১৫০টি সুপারিশ রেখেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিক কোনো সংগঠন না রাখার সুপারিশ করেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। কমিশন বলেছে, রাজনৈতিক দলের ছাত্র, শিক্ষক ও শ্রমিক সংগঠন, ভ্রাতৃপ্রতিম বা যেকোনো নামেই হোক না কেন, না থাকার বিধান করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
প্রতিবেদনের বিষয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এটা একটা গুরু দায়িত্ব। নির্বাচনব্যবস্থা ‘ভেঙে’ গিয়েছে, এটাকে জোড়া লাগানোর জন্য এই সংস্কার কমিশনের প্রচেষ্টা। আমরা কতগুলো প্রস্তাব করেছি, যেগুলো পরিস্থিটাকে আরও উত্তপ্ত করতে সহায়তা করবে।
নির্বাচনব্যবস্থায় যাতে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হয়, সে চেষ্টার করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, একই সঙ্গে সব অংশীজনের দায়বদ্ধতা যেন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নির্বাচনটা যেন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়, ভোটারের ভোট দেওয়ার অধিকার যাতে প্রতিষ্ঠিত হয়, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করেছি। ১৫০টির মতো ছোট-বড় সুপারিশ রয়েছে। নির্বাচনীব্যবস্থায় সংস্কার আনতে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ে সংবিধান সংক্রান্ত সুপারিশ রয়েছে।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ১৮টি উল্লেখযোগ্য জায়গায় ১৫০টির মতো সুপারিশ করেছি। এ সুপারিশের অন্যতম লক্ষ্যÑ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। তাদের ক্ষমতায়িত করা। একই সঙ্গে তাদের দায়বদ্ধ করা। দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা যাবে, সে আশা করাও দুরাশা বলে মন্তব্য করেন কমিশনপ্রধান।
রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক চর্চা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিষয়ে তিনি বলেন, দায়বদ্ধতার বিধান অন্তর্ভুক্ত করেছি, এটা চারটিখানি কথা নয়। এটা বলা সহজ; কিন্তু এটা আমাদের করতে হবে।
প্রতিবেদনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুপারিশ রয়েছে। প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয়ে কিছু ‘অভিনব’ প্রস্তাবও করা হয়েছে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বিষয়ে তিনি বলেন, এখন যে ব্যবস্থা রয়েছে তা আলঙ্কারিক। তা অসম্মানিত করে। আমরা ‘ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি’তে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার প্রস্তাব করেছি। নির্বাচনী অপরাধের বিচার সুসংহত করে তাদের যেন দায়বদ্ধ করা যায়, সে বিষয়ে সুপারিশ করেছি।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ভোটের কথা উল্লেখ করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিশেষত গত তিনটি নির্বাচনে যারা নির্বাচন ব্যবস্থাকে নির্বাসনে ফেলে দিয়েছে। কর্মকর্তা শুধু নয়, আমাদের কমিশন সদস্যরা, তাদের ব্যাপারে তদন্ত করার, বিশেষত ২০১৮ সালের মধ্যরাতে অভূতপূর্ব কা- ঘটেছে সে ব্যাপারে তদন্ত করে তাদের বিচারের আওতায়, দায়বদ্ধতার আওতায় আনা বলে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। সংস্কার কাজকে এগিয়ে নিতে আরও কিছু আইনের খসড়া নিয়ে কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। আরও দুই-একটা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিছু আইন রয়েছে সংস্কার করা দরকার। ইতোমধ্যে কিছু গুছিয়ে আনা হয়েছে। এজন্য সময় দিতে হবে।
পুলিশের শক্তি প্রয়োগের সীমা নির্ধারণ করে পুলিশ সংস্কারের সুপারিশ : পুলিশ সংস্কার কমিশন ১৫ দফা সুপারিশসহ তাদের প্রতিবেদন দাখিল করেছে। যেখানে নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত পুলিশ বাহিনী গড়তে একটি স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া বেআইনি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের শক্তি প্রয়োগের সীমা নির্ধারণ, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও আসামিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা যেন পুলিশ বাহিনী অনুসরই করে এ সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া পুলিশ বাহিনী সংস্কারের জন্য ২২টি আইনের সংশোধন ও পরিমার্জন চেয়েছে এই কমিশন। এ ছাড়া আদালতের আদেশ ব্যতীত কোনোক্রমেই এফআইআর বহির্ভূত আসামিদের গ্রেপ্তারে বারণ করা হয়েছে কমিশনের সুপারিশে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে দাখিলকৃত প্রস্তাবে র্যাবের বিলুপ্ত চেয়েছিল। তবে পুলিশ সংস্কার কমিশন বিলপ্তি চায়নি। কমিশন র্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো পর্যালোচনা ও পুনর্মূল্যায়নের সুপারিশ করেছে।
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন বলেন, ২ লাখ ২০ হাজারের বেশি পুলিশকে তিন হাজারের বেশি আইন নিয়ে কাজ করতে হয়। সব আইন খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। তবে ২২টি আইনের হয় সংশোধন, পরিমার্জন বা কোনো ক্ষেত্রে পরিবর্তন করতে হবে। ওই ২২টি আইনের কোন কোন ক্ষেত্র আমাদের আপত্তি আছে, বলে দিয়েছি; বলে সুপারিশ করেছি আমরা।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ বলেছেন ভিড় বা জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কিছু নিয়মকানুন আছে। তিনি বলেন, এটার ব্যাপারে আমরা কোনো আইডিয়া দেইনি। ইউরোপের মডেলটাই ফলো করতে বলেছি।
কমিশনের প্রতিবেদনে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার এবং রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়েও সুপারিশ করেছে। সফর রাজ হোসেন বলেন, দুটো ক্ষেত্রেই হাইকোর্ট এবং সুপ্রিমকোর্টের কিছু নির্দেশনা আছে, সেগুলো যদি বাস্তবায়ন করা যেত তাহলে হয়ত বা জনসাধারণের কষ্ট লাঘব হত। এক্সেসিভ ফোর্স ব্যবহার, নির্বিচারে কোনো গ্রেপ্তার করতে পারত না। নির্দেশনা মানতে হতো। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এটার একটা রিভিউ পিটিশন দেওয়া আছে, যার ফলে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অনুরোধ করেছি, সরকার যেন এটা উইথড্রো করে, তাহলেই ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া প্রতিটি থানায় নারী পুলিশের জন্য একটি ডেস্ক করার সুপারিশ করা হয়েছে।
চাকরির জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিষয়ে কমিশন যে সুপারিশ করেছে সেগুলো শিগগিরই বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করেন সফর রাজ প্রধান। তিনি বলেন, এটার ক্ষেত্রে খুব ইজি করা সম্ভব। কারণ এখন ন্যাশনাল আইডি কার্ড হয়েছে। চাকরির সময় আত্মীয় স্বজন রাজনীতি করে কিনা এটা দেখা হতো। এসবির সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা সুপারিশ করেছি যাতে সহজ হয় ভবিষ্যতে এবং এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
পুলিশ কমিশনের সুপারিশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় যাতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পদক্ষেপ নিতে পারে তার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া মানবাধিকার ও সংবিধান এবং আইন লঙ্ঘনের ঘটনা হলে তাৎক্ষণিক প্রতিকারে একটি হেল্পলাইন চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত ডোপ টেস্টের আওতায় আনতে সুপারিশ করা হয়েছে। ৮ ঘণ্টার বেশি ডিউটি করালে প্রণোদনা চালু করতেও সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ সুপার ও থানার ওসিদের পদায়ন করতে একটি ফিটলিস্ট তালিকা তৈরি এবং সেখান থেকে পদায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের উন্নত প্রশিক্ষণ বিশেষ করে মানবাধিকার বিষয়ক প্রশিক্ষণে জোর দিতে বলা হয়েছে। পুলিশের দুর্নীতি রোধে প্রতিটি থানা ও উপজেলায় একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। জুলাই-আগস্ট গণ-আন্দোলনকালে ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও আহত করার সঙ্গে দায়ী পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করতেও সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন।
প্রসঙ্গত, গত ৩ অক্টোবর নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন হয়েছিল আর সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল ৬ অক্টোবর। এরপর গত ১৮ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে গঠন করা হয় গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী বিষয়ক ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমার কথা থাকলেও প্রথম ধাপে গঠিত ছয়টি কমিশনের মেয়াদ পরে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এর মধ্যে চার কমিশন গতকাল প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রথম ধাপে গঠিত বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সুপারিশমালার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য দ্বিতীয় ধাপে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। এ কমিশনের সদয হিসেবে ছয়টি কমিশনের প্রধানরা রয়েছেন। তৃতীয় ধাপে ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় আইন ও নীতি প্রণয়নের কাজ শুরু হবে। চতুর্থ ধাপে হবে বাস্তবায়ন।