বিশাল ব্যবসা রাজস্ব কর্মকর্তা জালালের
শেয়ার বিক্রির নামে প্রতারণার ফাঁদ ।। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে বায়ু সায়েন্স অ্যান্ড নিউট্রিশন লিমিটেড
সরকারি চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী, ব্যবসার সুযোগ না থাকলেও কোম্পানি গঠন করেছেন। স্ত্রীকে চেয়ারম্যান করা হলেও নিজেই সব কিছু দেখভাল করেন। প্রভাব বিস্তারে অংশীদার বানিয়েছেন সরকারি বিভিন্ন শ্রেণির কর্মকর্তাদের। চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদেই রয়েছে তিন হাজার ৯৬২ স্কয়ার ফিটের বিশাল একটি অফিস। গাড়ির শোরুমসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় রয়েছে বিনিয়োগ। স্ত্রীকে নিয়ে এমন আলিশান ব্যবসা গড়ে তুলেছেন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) জালাল উদ্দিন মিয়া। তিনি বর্তমানে সিলেট কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট কার্যালয়ে কর্মরত।
চট্টগ্রাম থেকে খুলনার পর সিলেটে যান; মূলত চট্টগ্রামে কর্মরত থাকা অবস্থাতেই ব্যবসার জাল বিস্তার করেছিলেন। আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে কাস্টমসের এ কর্মচারীর ব্যবসা ও প্রতারণার নানা ঘটনা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৯ সালে গবাদিপশুর খাদ্য পরীক্ষাগার ‘বায়ো সায়েন্স অ্যান্ড নিউট্রিশন লিমিটেড’ নামে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন জালাল। চট্টগ্রামের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাণিজ্যিক এলাকায় বিশাল ফ্লোর ৫ বছরের জন্য ভাড়া নিয়ে অফিসের সাজসজ্জার কাজ সম্পন্ন করেন। নিয়োগ দেন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী।
সূত্র জানায়, বায়ো সায়েন্স অ্যান্ড নিউট্রিশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক করা হয়েছিল জালালের চাচা মোহাম্মদ মিজানকে। কিন্তু শুরুতেই চাচা-ভাতিজার মধ্যে সমস্যা দেখা দিলে
কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ-ছাঁটাই চলতে থাকে। লোক নিয়োগ আর ছাঁটাইয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে ‘মুসকাল’ হয়ে যায়। ওই অফিসে বর্তমানে ‘মুসকাল’ নামেই সাইন বোর্ড দেখা গেছে।
১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার ১৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে- কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের অনুমোদন ছাড়া, সরকারি কাজ ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসায় জড়িত হতে অথবা অন্য কোনো চাকরি বা কাজ গ্রহণ করতে পারবেন না। পরিবারের সদস্য অর্থাৎ স্ত্রী-সন্তানও ব্যবসা করতে পারবেন না। তবে একজন নন-গেজেটেড সরকারি কর্মচারী অনুমোদন ছাড়া তার পরিবারের সদস্যদের শ্রম কাজে লাগিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে সম্পত্তির ঘোষণাপত্রের সঙ্গে ব্যবসার বিস্তারিত বিবরণ দাখিল করতে হবে। বিধিমালার ১৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারী কোনো ব্যাংক বা অন্য কোনো কোম্পানি স্থাপন, নিবন্ধীকরণ বা ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
জানতে চাইলে সিলেট কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার মো. তাসনিমুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীর ব্যক্তিগত চাকরি বা ব্যবসার সুযোগ নেই। তবে এআরও জালাল উদ্দিন মিয়ার ব্যক্তিগত বিষয়ে আমি অবগত নই।’ এ ধরনের অভিযোগ থাকলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংশ্লিষ্ট শাখায় কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
জানা গেছে, ১০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৪ নভেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে এআরও হিসাবে কর্মরত ছিলেন জালাল উদ্দিন মিয়া। চট্টগ্রাম থেকে খুলনা এবং সেখান থেকে সিলেট বদলি হন। সিলেট চাকরি করলেও পরিবার নিয়ে রাজধানী ঢাকায় থাকেন। ঢাকায় ব্যক্তিগত ফ্ল্যাটের পাশাপাশি চট্টগ্রামে একাধিক ব্যবসা ও সম্পদ রয়েছে।
সূত্র জানায়, ফরিদপুরের বাসিন্দা জালাল কর্মচারী হলেও কাস্টমসের চাকরি সূত্রে প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে পরিচয়কে কাজে লাগিয়েছেন। রাজনৈতিক কারণে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচারের দোসর আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ী নেতাদের ব্যবহার করেছেন প্রয়োজনে। পাশাপাশি পেশাগতভাবে শক্তিশালী কর্মকর্তাদেরও অংশীদার করেছেন। তার প্রতারণা ও অসৎ উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে অধিকাংশই তাকে ছেড়ে গেছেন। সূত্র বলছে, মুসকাল গঠনের পর সিআইডির এক এসপিকে অংশীদার করেছিলেন জালাল। সেই সুবাদে সিআইডি স্টিকারযুক্ত গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করতেন জালাল ও তার স্ত্রী। বিষয়টি জানার পর ওই এসপি ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
জানতে চাইলে গত শনিবার জালাল উদ্দিন মিয়া আমাদের সময়কে জানান, ঢাকার বাসায় অবস্থান করছেন। আগামী রবিবার সকালেই সিলেট কর্মস্থলে থাকবেন। চট্টগ্রামে থাকাকালীন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘ওটা বহুত আগেই ভেনিশ হয়ে গেছে। এখন আর অস্তিত্ব নাই।’ অফিস আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, ছেড়ে দিয়েছি।’ পরে আবার বলেন, ‘ঠিক জানি না। আমি কনসালট্যান্ট হিসাবে ছিলাম বহুত আগে।’
পুরো ব্যবসা আপনিই নিয়ন্ত্রণ করেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন. ‘যারা বলছে তাদের ডকুমেন্টস দেখাতে বলেন।’ সিটি ব্যাংকে স্ত্রীসহ একটি যৌথ হিসাবের কথা জানালে তিনি বলেন, বউয়ের পেমেন্ট আমি দিতেই পারি।’ ব্যবসার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, এ বিষয়ে আর কিছু বলতে পারব না, কিছু বলার নাই, স্যরি ভাই’ বলেই মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। পরে কল দিলেও তিনি আর রিসিভ করেননি। তার স্ত্রী রুপা আক্তারের মোবাইলে কল দেওয়া হলে তিনিও রিসিভ করেননি।