জাগৃকে চলছে আ.লীগ দোসরদের পুনর্বাসন
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নে মরিয়া জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ (জাগৃক)। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ঘাপটি মেরে বসে থাকা সুবিধাভোগীদের ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ জোনগুলোতে অর্থের বিনিময়ে পদায়নের অভিযোগ উঠেছে জাগৃক সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) কাজী আতিয়ুর রহমানের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি আওয়ামী দোসরদের পুনর্বাসনে এবং নিজ এলাকার কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ জোনে পদায়নে একের পর এক বদলি করছেন, যার নেপথ্যে রয়েছে মোটা অংকের আর্থিক বাণিজ্যও। এতে যোগ্য, মেধাবী এবং আওয়ামী সরকারের আমলে কোণঠাসা কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেক কর্মকর্তাকে কোনো রকম কারণ ছাড়াই ছয় মাস না যেতেই বদলি করা হয়েছে, যা জাগৃকের বিধিবহির্ভূত।
যদিও জাগৃক কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বদলি করা হয়েছে। এখানে কারও প্রতি অবিচার করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে জাগৃকের একাধিক কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যমতে, যাদের ঢাকায় আনা হচ্ছে, তারা বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী। তারা আগের সরকারের সময়েও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছিলেন।
সম্প্রতি বদলিকৃত কর্মকর্তাদের একজন খুলনা উপবিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী দেবাইন চন্দ্র সরকার। এই দেবাইন চন্দ্র সরকার বরিশাল-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথের চাচাতো ভাই। তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে আওয়ামী লীগের প্রচার চালানোর একাধিক পোস্ট দেখা গেছে। একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তিনি একটি দলের কর্মকাণ্ডে নিয়মিত প্রচারণা চালাতেন। তিনি বিগত সরকারের সময় নিজেকে পঙ্কজ নাথের নিকটাত্মীয় বলে পরিচয় দিতেন। জানা গেছে, তিনি তৎকালে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে উপ-সহকারী প্রকৌশলীর দায়িত্ব থাকা অবস্থায় অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবেও কাজ করেছেন। নতুন করে তাকে আবার ঢাকায় বদলি করা হয়েছে। সূত্র বলছে, তিনি কাজী আতিয়ুর রহমানের আঞ্চলিক কোটায় এবং অর্থের বিনিময়ে ঢাকায় বদলি হয়েছেন।
একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে জানান, ঢাকা ডিভিশনের মধ্যে মিরপুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। আওয়ামী লীগের ট্যাগ লাগানো একজন কর্মকর্তাকে (দেবাইন সরকারকে) কীভাবে এ সময় এখানে বদলি করা হয়েছে, এটি তাদেরও প্রশ্ন।
আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী আরেক কর্মকর্তা আকলিমা খানম। তিনি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকার সমন্বয়ক শহীদ উল্লাহ খন্দকারের আস্থাভাজন ছিলেন। তিনি সাবেক সচিবের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি তাকে সিলেট হাউজিং প্রশাসনিক কর্মকর্তা থেকে ঢাকার মোহাম্মদপুর হাউজিং এস্টেটে পদায়ন করা হয়েছে। সূত্র বলছে, তাকেও মোটা টাকার বিনিময়ে ঢাকায় পদায়ন করেছেন কাজী আতিয়ুর রহমান।
খুলনা হাউজিং এস্টেট প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমিন আওয়ামী লীগ আমলে ভালো জায়গায় পদায়ন পেয়েছেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাকে খুলনায় বদলি করা হয়। সূত্র বলছে, ছয় মাস না যেতেই তাকে মোটা টাকার বিনিময়ে আবার ঢাকার মিরপুর হাউজিং এস্টেটের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। সরকারি চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী, কোথাও বদলি করা হলে কমপক্ষে তিন বছর সেখানেই থাকতে হয়।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
আঞ্চলিক কোটায় বদলি হয়েছেন এসএম তারিকুল হাসান। তাকে উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) ও নির্বাহী প্রকৌশলী পরিকল্পনা ও ডিজাইন ডিভিশন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীর কার্যালয়ে (মিরপুর) পদায়ন করা হয়েছে।
এ ছাড়া মিরপুর হাউজিং এস্টেটের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আরিফুজ্জামানের বিরুদ্ধে অনিয়মের একাধিক অভিযোগ থাকার পরও তাকে কুমিল্লা প্রশাসনিক কর্মকর্তার পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সেগুনবাগিচা দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। ইতোপূর্বে এ কর্মকর্তার বিভিন্ন অনিয়মের প্রমাণসহ আমাদের সময়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সেই প্রতিবেদনের পরও কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বরং পুরস্কৃত করেছে। এবারও তেমনটাই করা হয়েছে।
আরিফুজ্জামান মিরপুর হাউজিং এস্টেটের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে মিরপুর সেকশন-৯ ব্লক-ঘ, রোড-৩/৩ এর ১৮নং পুনর্বাসন প্লটটি হস্তান্তর ও নামজারি অনাপত্তির বিষয়ে এক মাসের ব্যবধানে দুটি প্রতিবেদন দেন। প্রথমে তিনি প্লটটির বিষয়ে ২০২৪ সালের ১৩ নভেম্বরে দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন- বর্তমানে প্লটটির চারদিকে বসবাসরত লোকজন অবৈধভাবে কিছু অংশ দখল করে তাদের বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এতে প্লটটির বরাদ্দ গ্রহীতা তার কাজটি করাতে ব্যর্থ হন। একাধিক সূত্র বলছে, তার হাতে মোটা অংকের টাকা তুলে দেওয়ার পর আরিফুজ্জামান ২০২৪ সালের ১ ডিসেম্বর পুনরায় প্রধান কার্যালয়কে অবহিত করেনÑ পুনর্বাসন প্লটটি বর্তমানে চারদিকে বাউন্ডারি করে খালি অবস্থায় রয়েছে। প্রধান কার্যালয়ে রক্ষিত মূল নথি যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। একই কর্মকর্তার সাংঘর্ষিক তথ্যভিত্তিক দুটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়টি প্রধান শাখার পরিচালকেরও (সম্পত্তি) দৃষ্টিগোচর হয়। তাই তিনি পুনরায় যাচাই করার নির্দেশ দেন।
জানা গেছে, এ রকম প্রতিবেদন জারির বিপরীতে প্রতিবার এক লাখ করে টাকা নেন আরিফুজ্জামান। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী অনেকেই মুখ খুললেও পরিচয় প্রকাশের বিষয়ে শঙ্কিত-ভীত।
এ ছাড়া মোহাম্মদপুর হাউজিং এস্টেটের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ হাওলাদারকে বদলি করা হয়েছে খুলনা হাউজিং এস্টেটে। তিনি গত ৩ জুন মোহাম্মদপুরে বদলি হয়ে যোগদান করেন। ছয় মাস না যেতেই কোনো কারণ ছাড়া তাকে খুলনায় বদলি করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
জানা গেছে, তার চাকরির বয়স আছে আর দুই থেকে আড়াই বছর। চাকরির শেষ জীবনে তিনি পরিবারের সঙ্গে থাকার ইচ্ছা পোষণ করলেও তাকে বদলি করা হয়েছে বিশেষ স্বার্থে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, কাজী আতিয়ুর রহমানের পছন্দের লোক ঢাকায় আনতেই হারুন অর রশিদ হাওলাদারকে বলি দেওয়া হয়েছে।
মো. হারুন অর রশিদ হাওলাদার আমাদের সময়কে বলেন, জানি না কী কারণে বদলি করা হয়েছে। আমার বয়স হয়েছে। চাকরি জীবনে বেশির ভাগ সময় ঢাকার বাইরে কাটিয়েছি। গত ৩ জুন ঢাকায় বদলি করা হলে একটু স্বস্তি পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এখান থেকে বিদায় নেব। কিন্তু ভাগ্যের কী খেলা! এই বয়সেও আবার বদলি করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের আদেশ। যেতেই হবে। চাকরি যেহেতু করি সব মেনে নিতেই হবে।
যার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, সেই কাজী আতিয়ুর রহমান নিজেও স্বীকার করেছেন, ঢাকায় যাদের পদায়ন করা হয়েছে- হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধাভোগী এবং তাদের বিরুদ্ধে তদবির বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে। এর পর তিনি যোগ করেন, বদলি আদেশ চেয়ারম্যান স্যার করেছেন। আমি নিজ থেকে কোনো বদলি করতে পারি না। শুধু অর্ডার করতে পারি। আমি বদলির অর্ডার করার আগে চেয়ারম্যান স্যারকে অবহিত করেছিলাম। তাকে বলেছিলাম, যাদের ঢাকায় পদায়ন করা হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধাভোগী এবং তাদের বিরুদ্ধে তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। তখন চেয়ারম্যান স্যার বলেছেন, ‘অর্ডার করে আনো। আমি দেখব।’ এখানে আমার কিছু করার নাই।
আর্থিক লেনদেনের যে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে আতিয়ুর রহমান বলেন, প্রশ্নই ওঠে না। কারণ আমার হাতে বদলি করার ক্ষমতা নেই।
যদিও জাগৃকেরই একাধিক কর্মকর্তার মতে, এটি তার অনৈতিক কাজকে ঢেকে রাখার অজুহাত। তারা আরও বলেন, আতিয়ুর নিজেও আওয়ামী লীগের শাসনামলে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন।
অন্যদিকে জাগৃক চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. নুরুল বাসির আমাদের সময়কে বদলির বিষয়ে বলেন, এটা রুটিন কাজ। বদলির ক্ষেত্রে কারও দলীয় পরিচয় দেখা হয় না। যারা দীর্ঘদিন এক জায়গায় ছিলেন, তাদের ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।