প্রশিক্ষণে অগ্রাধিকার মানবাধিকার সুরক্ষায়
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে পুলিশ পেশাদারত্বের বাইরে গিয়ে ক্রমাগত মারমুখী আচরণ করে। আন্দোলন দমনে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। চালায় অমানবিক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ। পুলিশের প্রাণঘাতী গুলি থেকে রক্ষা পাইনি শিশুও। চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই ঘটনায় সমালোচনার খাতা খোলে পুলিশ। আস্থা হারায় জনগণের। এমন প্রেক্ষাপটে জনআস্থা ফেরাতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। এর মধ্যে পুলিশ বিভাগ ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি পুলিশের প্রশিক্ষণে মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মানুষের মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকারবিষয়ক প্রশিক্ষণে নতুন যুক্ত করা হচ্ছে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স কোর্স।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জুলাই-আগস্টে গণ-আন্দোলন দমন করতে গিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে পুলিশ যে ভঙ্গুর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে, ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে চায় না। এ জন্য সারদা পুলিশ একাডেমি, পুলিশ স্টাফ কলেজ এবং টাঙ্গাইলে মহেরা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে পুলিশকে মানবাধিকার বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এরই মধ্যে পুলিশ স্টাফ কলেজে পুলিশ কমান্ডারদের এ ধরনের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে। সেখানে পুলিশ সুপার থেকে অতিরিক্ত আইজি পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নেবেন। শিগগিরই পুলিশ একাডেমি সারদা ও মহেরা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ শুরু হবে। সেখানে পুলিশ কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নেবেন। আর পুলিশ একাডেমি সারদায় প্রশিক্ষণ নেবেন এএসপি, অতিরিক্ত এসপিগণ। পর্যায়ক্রমে পুলিশের ইন সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারগুলোতেও মানবাধিকার বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে পুলিশ সদস্যদের।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর আমাদের সময়কে বলেন, পুলিশ সদস্যদের বেসিক ট্রেনিংয়ে মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। এ বিষয়গুলো প্রশিক্ষণ মডিউলে অন্তর্ভুক্ত। মানবাধিকার সমুন্নত রেখে পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে ইন-সার্ভিস ট্রেনিংয়েও এ বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা প্রশিক্ষণে মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
পুলিশ বাহিনী সংস্কারে কাজ করছে সংস্কার কমিশন। এ মাসেই তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে দাখিল করার কথা রয়েছে। সংস্কার কমিশন সরকারের কাছে যে প্রতিবেদন দাখিল করবে, সেখানে পুলিশের প্রশিক্ষণে মানুষের মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকার সুরক্ষায় বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুপারিশ থাকছে। এ ছাড়া বল প্রয়োগ, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার, আটক ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশকে কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে, তার সুপারিশও থাকছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন এবং উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে তাদের মতামত বা সুপারিশ দিয়েছে। বেশিরভাগ সুপারিশেই মানুষের মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকার সুরক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে সংস্কার কমিশনে যে প্রস্তাব দাখিল করা হয়েছে, সেখানেও মানুষের মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, বিগত ১৫ বছরে পুলিশ দলবাজ বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। যে কারণে বার বার মানবাধিকার লঙ্ঘন করেও সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য শাস্তির আওতায় না আসায় একই অপরাধ বার বার করেছে। আটক, গ্রেপ্তার এবং আচরণের ক্ষেত্রে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। বল প্রয়োগ ও গ্রেপ্তার-আটকের ক্ষেত্রে যে ধরনের নীতি ও আইন বিধি বিধান অনুসরণ করা দরকার ছিল তা করেনি। ছিল না কোনো জবাবদিহি। এরই ধারাবাহিকতায় জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে পুলিশ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে হত্যাযজ্ঞ চালায়। যে কারণে ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর পুলিশ বাহিনী চরম সংকটে পড়ে। ভেঙে পড়ে পুলিশের মনোবল। এখনও পুলিশ পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। খোলনলচে বদলে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ এখনও বাহিনীর সামনে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, মানবাধিকার বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণে দুই ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ক্লাসরুমে শেখানো হবে সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইন কানুনে মানুষের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার সুরক্ষায় কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা আছে। আর মাঠকেন্দ্রিক প্রশিক্ষণে বল প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশকে ঝুঁকির সঙ্গে সামনঞ্জস্যপূর্ণ কী ধরনের আচরণ করতে হবে, তা শেখানো হবে। কোনো মানুষকে আটক কিংবা গ্রেপ্তার করা হলে তাকে যেমন জানাতে হবে; তেমনি তার স্বজনদেরও জানাতে হবে। গ্রেপ্তার ও আটক করা ব্যক্তির সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে হবে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স ক্লাসে তা শেখানো হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও সমাজ অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশের বাস্তবতায় পুলিশের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। অন্যান্য দেশের যে প্রশিক্ষণব্যবস্থা আছে, আমাদের দেশীয় বাস্তবতায় তা কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেই কৌশল বের করতে হবে। পুলিশের রুটিন ওয়ার্ক, গ্রেপ্তার ও তদন্তে যে ঘাটতি, তা চিহ্নিত করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি পুলিশকে মানবিক করে গড়ে তুলতে জোর দিতে হবে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার ওপর।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, পুলিশের প্রশিক্ষণে আগেও মানুষের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের দিকটি ছিল। কিন্তু সেটা প্রশিক্ষণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ছিল না। এ ছাড়া প্রশিক্ষণের চর্চা আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ছিল না বললেই চলে। এখন সেটা মাঠে প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে পুলিশ আর খুনি বাহিনীর তকমা পাবে না।