৯ বছরেও ফেরেননি কুষ্টিয়ার স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা

মাহবুব-উল আলম হানিফের রোষানলে নিখোঁজ

শামসুল আলম স্বপন, কুষ্টিয়া
৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
৯ বছরেও ফেরেননি কুষ্টিয়ার স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা

কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সবুজ (৪০) ছিলেন এক প্রতিবাদী নেতা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুব-উল আলম হানিফ ও তার চাচাতো ভাই কুষ্টিয়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতার নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। এ কারণে প্রভাবশালী ওই দুই নেতার বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। তবে অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করায় তিনি এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। এরিমধ্যে ঘোষণা দেন কুষ্টিয়া পৌরসভায় মেয়র পদে নির্বাচন করার। এতে ক্ষুব্ধ হন এমপি হানিফসহ দলের অনেক নেতা। ষড়যন্ত্র হয় সবুজকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার; কিন্তু সংগঠনে তার জনপ্রিয়তার কারণে সেটা ব্যর্থ হয়। এর পর শুরু হয় তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত। হানিফ-আতার নির্দেশে গুম করা হয় সবুজকে। এর পর কেটে যায় ৯ বছর। আজ পর্যন্ত তার সন্ধান মেলেনি। এমন অভিযোগ সবুজের স্ত্রীসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের।

এদিকে দীর্ঘ দিনেও সজিবের কোনো সন্ধান না পাওয়ায় তিনি জীবিত আছেন কিনা সেটা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। পুত্রশোকে গত ১২ ডিসেম্বর মারা যান মা সাহিদা বেগম (৬০)। বাবা কাইজার হোসেনও (৭০) মৃত্যুশয্যায়।

অভিযোগে বলা হয়, ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে মজমপুর গেটে বঙ্গবন্ধু ম্যুরালে শ্রদ্ধা জানাতে যান সাজ্জাদ হোসেন সবুজ। ওই সময় হানিফ-আতার দির্দেশে তাদের ক্যাডার কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোমিনুর রহমান মোমিজ ও তার অনুগতরা সবুজকে হত্যার জন্য তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। তিনি বেঁচে গেলেও কুষ্টিয়া পৌর এলাকার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সবুজ (৩৫) নামে অপর এক যুবক ঘটনাস্থলে নিহত হন।

ঘটনার দিনই দুপুর ২টার দিকে হানিফের দালালখ্যাত জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান লাবু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হালিমুজ্জামান হালিম, মোমিজের ছোট ভাই হাফিজুর রহমান হাফিজসহ আরও তিনজন সবুজের বাড়িতে যান। তারা সবুজকে বলেন, ‘তোমাকে এখনই নেতার (হানিফের) বাড়িতে যেতে হবে, নেতা ডাকছেন।’ সবুজ বাধ্য হয়ে তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে হানিফের কুষ্টিয়ার বাড়িতে যান। হানিফ তার গোপন কক্ষে ডেকে নিয়ে সবুজকে বলেন, ‘তোমার বিরুদ্ধে হত্যা মামলার প্রস্তুতি চলছে। তুমি যে কোনো সময় গ্রেপ্তার হয়ে যাবা। গ্রেপ্তার হলে ক্রসফায়ারে মারা যাবা। আমার কিছুই করার থাকবে না। যদি বাঁচতে চাও তা হলে আমার কথামতো চলতে হবে। তুমি এখুনি লাবুকে সঙ্গে নিয়ে গাজীপুরের ড্রিম স্কয়ার রিসোর্টে চলে যাও। আমি রিসোর্টের মালিককে বলে দিচ্ছি, সেখানে তুমি নিরাপদে থাকতে পারবে।’ হানিফের কথামতো ওই রিসোর্টে ওঠেন সবুজ ও লাবু। সেখানে অবস্থানকালে গভীর রাতে লাবুর যোগসাজশে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ১০-১২জন সাদা পোশাকধারী সবুজকে রিসোর্ট থেকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যান। এর পর গত ৯ বছরেও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া আমাদের সময়কে বলেন, আমার স্বামী কুষ্টিয়া পৌর মেয়র পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন; কিন্তু এমপি হানিফ, তার ভাই আতা, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রবিউল ইসলামরা বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। আমাদের ধারণা, হানিফ-আতার নির্দেশেই আমার স্বামীকে গুম করা হয়। সবুজের সন্ধান পাওয়ার জন্য আমার শ^াশুড়িসহ পরিবারের সবাই এমপি হানিফের কাছে যান। তিনি (হানিফ) বলেন, তোমরা চিন্তা করো না আমি দেখছি। এর পর কোনো সন্ধান না পেয়ে আমরা এমপি হানিফকে জাতীয় প্রেসক্লাবে সবুজের সন্ধান চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করার কথা জানাই। তিনি তাতে বাধা দিয়ে বলেন, সংবাদ সম্মেলন করলে যদি সবুজকে মেরে ফেলে তা হলে আমার কোনো দায় থাকবে না। সেই থেকে আমরা হানিফের ওপর ভরসা করে বসেছিলাম। গত ৫ আগস্টের পর আমরা সবুজের সন্ধানে ডিজিএফআই ও র‌্যাবের আয়নাঘরে সন্ধান করেও তাকে পাইনি...। ছেলে শাহেদ হোসেন (২২) ও মেয়ে সুমাইয়া (১৩) প্রায় প্রতিদিন বাবা বাবা বলে কাঁদে। আমাদের বিশ^াস, হানিফই সবুজকে গুম করিয়েছেন। ও জীবিত আছে কিনা তা হানিফই বলতে পারবেন। তাকে গ্রেপ্তার করা গেলেই সবুজের গুম-রহস্য জানা যেত।

এদিকে সবুজের ভাই আরিফুল হোসেন সজিব বাদী হয়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গুম ও হত্যা ঘটনায় একটি মামলা করেন। আদালত কুষ্টিয়া মডেল থানাকে মামলাটি গ্রহণ করে আসামিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশনা দিয়েছেন।

আরিফুল হোসেন সজিব আমাদের সময়কে বলেন, আমার ভাইয়ের জনপ্রিয়তায় ঈষান্বিত হয়ে ওরা পরিকল্পিতভাবে তাকে গুম ও হত্যা করেছে। ভ্ইায়ের শোকে আমার মা গত ১২ ডিসেম্বর মারা যান। আমার বাবাও এখন মৃত্যুশয্যায়। এদিকে আমাকে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে মামলা প্রত্যাহারের জন্য। আসামিরা পলাতক থাকায় এ ব্যাপারে কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শিহাব উদ্দিন শিহাব বলেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নিখোঁজের ৯ বছর পর গুমের অভিযোগে আদালতে মামলা হয়েছে। মামলাটি তদন্তধীন। আসামিরা আত্মগোপনে থাকার কারণে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তদন্ত শেষে আসামিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।