খ্রিস্টানপাড়া পোড়ানোর ঘটনায় বেনজীরের নাম

বান্দরবান সংবাদদাতা
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
খ্রিস্টানপাড়া পোড়ানোর ঘটনায় বেনজীরের নাম

বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার তঙ্গঝিরি এলাকার পূর্ব-বেতছড়াপাড়ায় ১৯ ত্রিপুরা পরিবারের মধ্যে ১৭টি বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় উঠে এসেছে পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের নাম। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার সবাই বেনজীরের হয়ে এ এলাকায় ভূমি দখলের কাজে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে। স্থানীয় ভুক্তভোগীদের বক্তব্যও তেমনই।

নিজ পাড়ায় গির্জা না থাকায় বড়দিনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পাশের পাড়ার গির্জায় গিয়েছিলেন পূর্ব-বেতছড়ি ত্রিপুরাপাড়ার খ্রিস্টানরা। এ সুযোগে পুরো পাড়া জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ঘরবাড়ি হারানো লোকজনের অভিযোগ, তাদের ভূমি দখল করতে এবং তাদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতেই ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

পূর্ব-বেতছড়া ত্রিপুরাপাড়া পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় লামা থানায় সাতজনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়েছে। এ ঘটনায় বেনজীরের কেয়ারটেকারসহ চারজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলেন- স্টিফেন ত্রিপুরা (৫০), মশৈনিয়া ত্রিপুরা (৪৪), জোয়াকিম ত্রিপুরা (৫২) ও কেয়ারটেকার মো. ইব্রাাহিম (৬৫)। এদের মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামে দখল করা জমির দেখভাল করতেন মো. ইব্রাহিম। তাদের সবার বাড়ি সরই ইউনিয়নে, আগুনে পুড়ে যাওয়া পাড়ার কাছেই।

অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৮ সাল পর্যন্ত এ পাড়ার আশপাশের পাহাড়ে জুমচাষ ও বিভিন্ন ফলদ গাছের বাগান করেন পাড়ার মানুষ। ওই বছর বেনজীরের লোকজন এলাকা ছেড়ে দিতে এবং অন্যত্র চলে যেতে পাড়ার মানুষকে প্রথমে ভয়ভীতি দেখান। পরে মারধর করে উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়। দখল করে নেয় প্রায় ৬০ একর পাহাড়ি ভূমি। উচ্ছেদ হওয়ার পর ওই পাড়ার প্রায় সবাই উদ্বাস্তু হয়ে পুরনো তঙ্গাঝিরিতে চলে যান। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ চাকরি থেকে অবসরে চলে গেলে পুনরায় ওই ১৯ ত্রিপুরা পরিবারের সদস্যরা আগের জায়গায় ফিরে এসে বসবাস শুরু করেন। গত নভেম্বরে বেনজীরের লোকজন মুঠোফোনে চাঁদা দাবি করে হুমকি দেন। এর কিছু দিন পর গ্রেপ্তারকৃত মশৈমিয়া, মো. রফিক ও আব্দুর শুক্কুরসহ ছয়-সাতজন বহিরাগত লোক সশরীরে পাড়ায় এসে সবাইকে চলে যেতে বলেন। পাড়া ছেড়ে না গেলে গুলি করে মেরে ফেলারও হুমকি দেন। ওই ঘটনায় পাড়াবাসী থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেন।

পূর্ব বেতছড়াপাড়ার কারবারি (পাড়া প্রধান) পাইসাপ্রু ত্রিপুরা বলেন, আমাদের পাড়ায় গির্জা না থাকায় পাড়াবাসী বড়দিন উদ?যাপনের জন্য গত মঙ্গলবার পার্শ্ববর্তী তঙ্গাঝিরিপাড়ার গির্জায় গিয়েছিলাম। এ সুযোগে দুর্বৃত্তরা পাড়া পুড়িয়ে দেয়। পাড়ার ১৯ বাড়িঘরে মধ্যে ১৭টি বসতবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গছে। এ পাড়ার জায়গা পুলিশ বেনজীরের বলে শুনেছি। কিন্তু কখনও তাকে দেখিনি। তবে তার লোকজন আসত। যেদিন গুলি করার হুমকি দিয়েছে, সেদিনও বেনজিরের কেয়ারটেকার মো. ইব্রাহিম আমাদের পাড়ায় এসেছিলেন।

সিয়ান্দ্র ত্রিপুরা নামে আরেক জন বলেন, গত ২৪ নভেম্বর বড় দিনের প্রার্থনা শেষে গির্জা থেকে বের হয়ে দেখি আমাদের পাড়ার দিকে আগুন জ্বলছে। পাড়ার দিকে দ্রুত যেতেই কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ শুনতে পাই। ভয়ে আমরা কেউ আর পাড়ায় যাইনি। সকালে গিয়ে দেখি আমার বাড়িসহ পাড়ার ১৭টি বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকজন জানান, পাড়া পুড়ে দেওয়ার ঘটনায় পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের নাম আসে। জোরপূর্বক ভূমি দখলের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর পরই বেনজীরের ম্যানেজার বান্দরবান জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মংওয়াইচিং মার্মা, কেয়ারটেকার মো. ইব্রাহিম ও মো. রফিকসহ আরও কয়েকজন নিজেদের আড়াল করে নেন। শেষ পর্যন্ত ইব্রাহিম পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান।

মামলার বাদী গুঙ্গামনি ত্রিপুরা বলেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের নাম করে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা মংওয়াইচিং মারমা, কেয়ারটেকার ইব্রাহিম, রফিক, দেলোয়ার বিভিন্ন সময় পূর্ব-বেতছড়াপাড়ার ত্রিপুরাদের হুমকি দিয়ে আসছিলেন। তারাই বাড়িঘরে আগুন দিয়েছেন। যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের বাইরে সুরেন্দ্র ত্রিপুরা, সিমিয়ন ত্রিপুরা, মংমেপ্রু মার্মা, মো. ফরিদ, আব্দুর শুক্কুর ও মো. রফিকসহ ২০-২৫ জন অজ্ঞাতনামা আসামি মামলার এজাহারে আছেন। তারা বিভিন্ন সময় পুলিশ অফিসারের নাম ভাঙিয়ে পাড়াবাসীকে উচ্ছেদ করার হুমকি দিয়েছে।

জানতে চাইলে বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার শহিদুল্লাহ কাওছার বলেন, মামলা করার পরপরই অভিযান চালিয়ে এজাহারভুক্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছি। এ ঘটনায় আরও জড়িত থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করা হবে। ইতোমধ্যে যে ঘটনা ঘটেছে, এ ধরনের আর যেন না ঘটে, সে ব্যাপারে পুলিশ সতর্ক থাকছে। তিনি স্থানীয় জনগণকেও সতর্কতা অবলম্বনের অনুরোধ জানান।