‘সম্পদটা আমি হারাইয়া ফেললাম’
ছেলেকে হারিয়ে শোকে কাতর ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়নের মা। বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন তিনি।
আজ বৃহস্পতিবার সচিবালয়ের আগুন নেভাতে গিয়ে ট্রাকের নিচে পিষ্ট হয়ে নিহত হন ২৩ বছরের তরুণ এই ফায়ার ফাইটার। সেই ট্রাকের চালকের শাস্তির দাবি জানান পরিবার ও স্বজনরা।
আজ দুপুরে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বড়বালা ইউনিয়নের আটকুনিয়া গ্রামে নিহত ফায়ার ফাইটার সোয়ানুরের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার মা নার্গিস বেগমের অনবরত আর্তনাদ। পাশের কক্ষে একমাত্র ভাইকে হারিয়ে বিলাপ করছেন বোন সীমা আক্তার।
সোয়ানুরের মা নার্গিস বেগম বলছিলেন, ‘গতকাইল রাইত ১০টার সময় ছাওয়ার সঙ্গে কথা হইছে। ছাওয়া কয়, “ভালোভাবে থাকেন মা। আমি টাকা দিব। ভালোভাবে খান মা, বাবাক খিলান। শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক রাখেন মা। বইনের অসুখ, তার বাচ্চা দুইটার অসুখ। বইনের বাচ্চা দুইটাক দেখেন মা।“ আমার মায়ের সম্পদ, বাপের সম্পদ সোগ শেষ করছি ছইলের ভবিষ্যতের জন্য। বাবা-বায়ের যতদিন মৃত্যু হয় নাই, ততদিন ছইল হামাক দেখপে, সেই সম্পদটা আমি হারাইয়া ফেললাম। এখন মা কে দেখপে। ছাওয়া মোর ঢাকাত যায়া কয়, “মা দোয়া করেন। আমি আরও ওপরত যামো।” সেই ছাওয়াক মোর আল্লাহ ওপরত নেইল।’
জানা যায়, মিঠাপুকুর উপজেলার আটকুনিয়া গ্রামের আক্তারুজ্জামান দুদুর দ্বিতীয় সন্তান সোয়ানুর জামান নয়ন। দুই ভাইবোনের মধ্যে কৃষক বাবার একমাত্র ছেলে ছিলেন এই ফায়ার ফাইটার। ২০১৬ সালে স্থানীয় ছড়ান দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ২০১৮ সালে ছড়ান ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে একই কলেজে ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়েছেন নয়ন।
ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়ন ও দুর্ঘটনাস্থল
২০২২ সালের ২ অক্টোবর সিলেটের বিশ্বনাথ ফায়ার স্টেশনে যোগদানের মধ্য দিয়ে কর্মজীবনের শুরু করেন নয়ন। দুই মাস আগে ঢাকার তেজগাঁও ফায়ার স্টেশন টিমের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন তিনি।
নয়নের বাবা আক্তারুজ্জামান দুদু বলেন, ‘ভোর ৫টার দিকে জানতে পারি, আমার ছেলে আগুন নেভাইতে গিয়ে ট্রাকচাপায় মারা গেছে। ছেলের স্বপ্ন ছিল বড় অফিসার হবে। দুই বছরের মধ্যে ছেলে আমার প্রমোশন পাইছিল। দেশের জন্য আমার ছেলে জীবন দিছে। ওরা যদি বেরিগেড দিয়ে কাজ করত, তাহলে তো আমার ছেলেটাক ট্রাক চাপা দিয়ে মারতে পারত না। আমি ট্রাকচালকের বিচার চাই। যে প্রশাসনের লোকের অবহেলার জন্য আমার ছেলের জীবন গেল, তার বিচার চাই।’
নয়নের বড় বোন সীমা আক্তার বলেন, ‘সবার ভাই আছে। আমার ভাই নাই। আমি আর কাকে ভাই বলব। ভাইয়ের অনেক স্বপ্ন ছিল, আশা ছিল। সে অনেক বড় অফিসার হবে। জানুয়ারি মাসে ভাই আসিয়া আমাক ভালো ডাক্তারকে দেখায়া চিকিৎসা করাবে। আমার বাচ্চা দুইটার অসুখ, তার ডাক্তার দেখাবে। সেই ভাই আইজ লাশ হয়া বাড়িত আসতুছে।’
মিঠাপুকুর ফায়ার স্টেশনের ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর ও ইনচার্জ মশিউর রহমান বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করি। আমরা চাই এভাবে আর যেন কোনো মায়ের কোল খালি না হয়। সহকর্মীকে হারিয়ে আমরা ব্যথিত। আমরা এসেছি শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে।’
উল্লেখ্য, গতকাল বুধবার দিবাগত রাত ১টা ৫২ মিনিটে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিটটি কাজ শুরু করে। তীব্রতা বাড়ার কারণে আরও ১৮টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে যোগ দেয়। একই সময়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সেনা ও পুলিশ সদস্যরা। এ সময় দিবাগত রাত ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে সচিবালয়ের দক্ষিণ দিকের ১ নম্বর ফটকের সামনে পানির পাইপ কাঁধে নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়নকে একটি দ্রুতগতির ট্রাক ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। এ সময় রাস্তায় পড়ে যান নয়ন। মাথায় পরা হেলমেটটি সঙ্গে সঙ্গে খুলে যায়। পরে ট্রাক ও ট্রাকের চালককে ধাওয়া করে আটক করে ঘটনাস্থলে থাকা লোকজন। আহত ফায়ার ফাইটারকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করার কয়েক ঘণ্টা পর মারা যান তিনি।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার