প্রস্তুত রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব, জানুয়ারির শুরুতে দাখিল
সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। গঠিত কমিশনগুলো ইতোমধ্যে অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক, জনসাধারণের মতামত, দেশ-বিদেশের আইন, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, বাস্তবতা ও কার্যকারিতা প্রভৃতি বিষয় পর্যালোচনা করে তাদের সুপারিশমালা প্রস্তুত করছে।
গত ৩ অক্টোবর নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন হয়। ৬ অক্টোবর গঠন করা হয় সংবিধান সংস্কার কমিশন। এ ছয়টি কমিশনকে তিন মাসের মধ্যে তাদের সুপারিশ জমা দিতে বলা হয়েছিল। জানা গেছে, আগামী জানুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে সরকারের কাছে এসব কমিশন তাদের সুপারিশ দাখিল করবে। কি আছে এসব কমিশনের সুপারিশে? এ নিয়েই আজকের প্রতিবেদন-
সংবিধান
সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য অধ্যাপক আলী রীয়াজকে প্রধান করে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এরপর দেশের বিদ্যমান সংবিধান ছাড়াও বিভিন্ন দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করে কমিশন। এ ছাড়া সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের সঙ্গে সংবিধান সংস্কার বিষয়ে মতবিনিময় করে। রাজনৈতিক দলগুলোও লিখিত প্রস্তাব দেয়। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাধ্যমে সারাদেশে একটি জরিপও চালানো হয়। কমিশনের প্রাথমিক প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করা, একজন ব্যক্তি কয়টি মেয়াদ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট করে
দেওয়া (সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ), প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা যাতে না হন, এমন বিধান করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। মূলত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং এক ব্যক্তির হাতে যাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না হয়, সে জন্য সংবিধানে এই বিধানগুলো যুক্ত করার প্রস্তাবের কথা বিবেচনা করছে কমিশন। এসব মতামত পর্যালোচনা করে আগামী ৬ জানুয়ারির মধ্যে কমিশনের প্রস্তাব সরকারের কাছে পেশ করার কথা রয়েছে।
বিচার বিভাগ
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রস্তাব করতে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এরপর থেকেই কমিশন সরেজমিন বিভিন্ন আদালত পরিদর্শন, মতবিনিময়সহ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করে। গত ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাধারণ নাগরিক, আইনজীবী, বিচারক ও আদালত সম্পর্কিত সহায়ক কর্মচারীসহ প্রায় ১৩ হাজার মানুষ ওয়েবসাইটে বিচার বিভাগ সংস্কার বিষয়ে মতামত দিয়েছেন। সংস্কার কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, প্রধান বিচারপতিসহ উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা, কোনো রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াই সর্বোচ্চ আদালত এবং জেলা আদালতে সরকারের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস (পরিষেবা) গঠন এবং ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় মামলার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনায় ‘স্বাধীন তদন্ত সংস্থা’ গঠনের সুপারিশ করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নিরপেক্ষ জনবল কীভাবে নিয়োগ করা যায়, কমিশন সে ব্যাপারে দীর্ঘদিনের প্রচলিত পদ্ধতি পরিবর্তনের সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে। জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলে জানা গেছে।
নির্বাচন
ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ তুলে ধরা হবে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন প্রণয়ন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পরিবর্তে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব প্রদান, নির্বাচন কমিশনের কাজের পরিধি, ‘না’ ভোটের বিধান আবার যুক্ত করা, সীমানা পুনর্নির্ধারণ আইনের পরিবর্তন, হলফনামা যাচাই, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন সহজ করা, প্রবাসীদের ভোটার করা প্রভৃতি। এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১২ (প্রার্থীর যোগ্যতা), ১৩, ৪৪ ও ৭৩ থেকে ৮৯ পর্যন্ত ধারা পরিবর্তনের সুপারিশ করা হতে পারে। বিতর্কিত নির্বাচনের জন্য বিগত তিনটি নির্বাচন কমিশনের বিচারের পাশাপাশি ভবিষ্যতে কোনো কমিশন এমন অপকর্মে জড়ালে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান করারও সুপারিশ আসতে পারে। রাজনৈতিক দলে নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর বিষয়েও সংস্কার কমিশন কাজ করছে। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) পরিবর্তে ব্যালট পেপার, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা চালুর বিষয়েও মতামত এসেছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হলে প্রচলিত পদ্ধতির ভোটে নিম্নকক্ষ গঠন এবং আনুপাতিক হারে উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে কমিশনে আলোচনা চলছে। নারী আসন সংখ্যা বৃদ্ধি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাদ দেওয়া, দলীয় প্রার্থী হতে হলে কমপক্ষে তিন বছর দলের সদস্য থাকা এবং নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনীকে আবার যুক্ত করার বিষয়ে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্কার কমিশন।
দুর্নীতি দমন
ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে দুদক সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় ও সাধারণ মানুষের মতামত গ্রহণ করেছে। কমিশনের পক্ষ থেকে দুদকের স্বাধীনভাবে কাজ করার পথে অন্তরায়গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক সুপারিশমালার মধ্যে দুদক কমিশনার নিয়োগে দলীয় বিবেচনা রোধ এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। পাশাপাশি কমিশনার নিয়োগে আইন, দুর্নীতি দমনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন, নিজস্ব কর্মকর্তা ও প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভাজন ও বৈষম্য নিরসন, উচ্চমাত্রা বা মহাদুর্নীতির বিষয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন চলছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা বিএফআইইউ, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডি, উচ্চ আদালতের অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার বিষয়টিও সুপারিশমালায় উঠে এসেছে বলে জানা গেছে। নির্ধারিত সময়ে এই সুপারিশমালা জমা দেওয়া হবে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
জনপ্রশাসন
এদিকে আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সম্ভাব্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছেÑ উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের ৫০ শতাংশ এবং অন্য সব ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কোটা রাখা, উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে পরীক্ষার আয়োজন যেখানে সবাই পরীক্ষা দিতে পারবে, একই সঙ্গে উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে যেখানে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৭৫ শতাংশ ও অন্য ক্যাডারের জন্য ২৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়, তা বদলে এই অনুপাত প্রশাসনের জন্য ৫০ শতাংশ ও অন্য ক্যাডারদের জন্য ৫০ শতাংশ করার সুপারিশ করা হতে পারে। এ ছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারে না রেখে আলাদা কমিশন করার বিষয়টিও পর্যালোচনা করে সুপারিশ করা হতে পারে জানা গেছে।
পুলিশ
সফর রাজ হোসেনকে প্রধান করে গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশনের সম্ভাব্য সুপারিশমালার মধ্যে রয়েছে পুলিশকে প্রাণঘাতী অস্ত্র না দেওয়া, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন ইত্যাদি সুপারিশ করা হতে পারে।
আগামী ৫ জানুয়ারি সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার শেষ সময় ধরা হচ্ছে। এরই মধ্যে একদফা প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দুই থেকে তিনটি কমিশন পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করার কথা জানিয়েছে। বাকিদের আরও এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিন সময় লাগতে পারে বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া গত ১৮ নভেম্বর গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারীবিষয়ক ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। প্রতিবেদন দাখিলে আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় পাচ্ছে এসব কমিশন।
জানা গেছে, কমিশনগুলোার প্রতিবেদন পাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে পর্যালোচনাপূর্বক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে বৈঠক করা হবে। বৈঠকে ঐকমত্য সাপেক্ষে সংস্কার বাস্তবায়ন করা হতে পারে।