সুন্দরবনে ফের সক্রিয় দস্যুরা

জেলে অপহরণ করে নিচ্ছে মুক্তিপণ প্রাণভয়ে পেশা ছেড়েছেন অনেকে

বিলাল হোসেন, শ্যামনগর (সাতক্ষীরা)
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
সুন্দরবনে ফের সক্রিয় দস্যুরা

২১ ডিসেম্বর সকাল ৯টা, টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিল। এমন সময় শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ বাজারে দুজন মানুষের দেখা মেলে। শরীরে তাদের শীতের গরম দাপট, গলায় মাফলার। দুজনের হাতে ছিল দুটো ব্যাগ। গায়ে মাখা সুন্দরবনের নদীর চরের কাদামাটি। কোথা থেকে এসেছেনকৌতূহলবশত প্রশ্ন করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা।

এই দুজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১৪ ডিসেম্বর কদমতলা স্টেশন থেকে পাস নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করেন তারা। ১৫ ডিসেম্বর সুন্দরবনের পুষ্পকাটি এলাকার মাঠে নদী থেকে কাঁকড়া শিকারের সময় দস্যু মজনু বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিপণের দাবিতে তাদের তুলে নিয়ে যায়। এরপর তাদের ওপর শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। টাকা না দিতে পারায় এক সপ্তাহের বেশি সময় আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন করে। খুব কষ্ট করে দুজন এক লাখ টাকা মুক্তিপণ পরিশোধ করেন। বনদস্যু মজনু বাহিনীর সদস্য আলিফ দাতিনাখালীর এক জেলের নৌকার মাধ্যমে তাদের বুড়িগোয়ালিনী নিয়ে উঠিয়ে দিতে বলে। সেখান থেকে মুন্সীগঞ্জ বাজারে এসে হরিনগরে যাওয়ার জন্য গাড়ি খুঁজছিলেন। সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরে নিজেদের নাম বলতে চাননি। পরে নাম জানালেও পুনরায় বনদস্যুদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে প্রতিবেদককে তাদের নাম উল্লেখ না করতে অনুরোধ করেন। তারা আরও জানান, সুন্দরবন থেকে বনদস্যু চলে না যাওয়া পর্যন্ত তারা আর কখনও সুন্দরবনে যাবেন না। প্রয়োজনে না খেয়ে পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন পার করবেন এবং অন্য কাজের জন্য বাইরে চলে যাবেন। তারা মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের হরিনগর গ্রামের জেলে।

শুধু এ দুজনের সঙ্গে সুন্দরবনের দস্যুরা এই অমানবিক আচরণ করেনি। আরও অনেকেই পাস নিয়ে সুন্দরবনে গিয়ে দস্যুদের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিনিয়ত অসংখ্য জেলেকে আটকে রেখে মুক্তিপণের মাধ্যমে ছেড়ে দিচ্ছে দস্যুরা। সময়মতো মুক্তিপণ না দিতে পারলে জেলেদের ওপর শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। মুক্তিপণ আদায়ের জন্য মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয় জেলেদের পরিবারের কাছে। প্রাণহানির ভয়ে অনেক জেলে পুনরায় সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাওয়ায় মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসার বিষয়টি স্বীকার করেন না।

একাধিক জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বনদস্যুদের সঙ্গে সবসময় ফোনের মাধ্যমে সাতক্ষীরা শহর থেকে কিছু মানুষ যোগাযোগ করছে। কখন কোন নৌকা নামছে, কোন এলাকায় যাচ্ছে এ ধরনের ইনফরমেশন বনদস্যুদের কাছে পাঠাচ্ছে তারা। এমনকি গোপনে বনদস্যুদের বাজার সদাই করে তাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে একটি চক্র। প্রশাসন চাইলে যে বিকাশ নাম্বারে টাকা পাঠানো হচ্ছে, সেটি ট্র্যাকিং করলে বনদস্যুদের শহর থেকে যারা সহযোগিতা করছে, তাদের ধরা

সম্ভব হবে। বিষয়টি নিয়ে জেলেরা মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমবেশ করেছেন। শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর স্মারকলিপিও প্রদান করেছেন। প্রশাসনকে একাধিকবার অবগত করলেও তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

গত ১৭ ডিসেম্বর তিন জেলেকে অপহরণ করা হয়। তারা হলেন শ্যামনগর উপজেলার হরিনগর গ্রামের নাজির সরদারের ছেলে রেজাউল ইসলাম (৩৮), গোলাম মোস্তফার ছেলে সুজন গাজী (২৭), খুলনার কয়রা উপজেলার দশালি গ্রামের শের আলী মোল্লা ওরফে কবিরাজের ছেলে এমদাদুল হক (৩৩)। ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন থানায় লুট হওয়া অস্ত্র নিয়ে জেল পলাতক আসামিরা বনদস্যুতায় নেমেছে বলে জেলেরা অভিযোগ করেছেন। তারা আরও অভিযোগ করেছেন, দস্যু মজনু বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিহ্নিত আত্মসমর্পণকৃত বনদস্য আলিফ ওরফে দয়াল, মিলন পাটোয়ারীসহ একাধিক সদস্য।

মজনু বাহিনীর পাশাপাশি নতুন করে বনদস্যুতায় নেমেছে গাবুরা ইউনিয়নের একসময়ের সুন্দরবনের আতঙ্ক জিয়া বাহিনীর প্রধান জিয়াউর রহমান, খোকাবাবু ও রাঙ্গা বিল্লাল। দস্যুতা মামলায় জেল থেকে জামিন নিয়ে ফের বনদস্যুতায় নেমে পড়েছেন তারা।

বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছিল। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়।

উপকূলের ৯০ শতাংশ মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সুন্দরবনে নতুন করে বনদস্যু ফিরে আসায় জেলের সংখ্যা কমছে। বাধ্য হয়ে অনেক জেলে পেশা ছেড়ে বিকল্প কর্মসংস্থান খুঁজছেন। অনেকে ইটভাটায় কাজ করতে চলে গেছেন। অনেক জেলে বনদস্যুর চাঁদার টাকা ম্যানেজ করতে না পেরে সুন্দরবনে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকেই আবার শহরে গিয়ে ভ্যান-রিকশা চালাচ্ছেন।

মুন্সীগঞ্জ গ্রামের আল মামুন বলেন, ‘সুন্দরবনের কাজ ছাড়া আর কিছু জানি না। বনে ডাকাত নামায় ভয় হচ্ছে একবার ধরলে এক লাখ টাকা কোথায় পাব? এ জন্য সুন্দরবনে যাওয়া বাদ দিয়ে ভাটায় চলে যাচ্ছি। কখনও যদি আগের মতো ডাকাত উঠে যায়, তা হলে আবার সুন্দরবনে যাব।’

হরিনগর গ্রামের সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘সুন্দরবনে বনদস্যু নামার আগে খুব সহজে মাছ ও কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে পারতাম। বউ-বাচ্চা নিয়ে এলাকায় থাকতে পারতাম। ৫ আগস্টের পর নতুন করে বনদস্যু ফিরে আসায় খুব সমস্যার মধ্যে পড়ে ঢাকার সাভারে ইটের ভাটায় কাজ নিয়েছি।

কথা হয় গাবুরা ইউনিয়নের আব্দুল আলীমের সঙ্গে। তিনি বলেন, মুক্তিপণের টাকা ম্যানেজ করতে না পেরে বনদস্যুর ভয়ে সাতক্ষীরা শহরে বউ-বাচ্চা নিয়ে রিকশা চালাই। যখন সুন্দরবনে বনদস্য ছিল না, তখন খুব ভালো ছিলাম। নিজ চিন্তায় সুন্দরবনে গিয়ে মাছ-কাঁকড়া ধরতাম।

সম্প্রতি একটি মাছ কোম্পানির কর্ণধার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, মোবাইল ফোনে জিয়া বাহিনীর পরিচয় দিয়ে প্রতিটা নৌকা থেকে বার্ষিক এক লাখ টাকা দিয়ে নদীতে মাছ ধরতে নামতে বলে। টাকা না দিয়ে মাছ ধরতে নামলে ‘খবর আছে’ বলেও জানানো হয়। চিন্তা করছি নৌকা আর সুন্দরবনে পাঠাব না, জেলেদের অন্য কাজের ব্যবস্থা করে দেব।

মৌখালী গ্রামের জেলে হোসাইন পাগলা বলেন, ‘মাছ কোম্পানির কাছ থেকে দাদন নেওয়া। সুন্দরবনের গিয়ে মাছ ধরে টাকা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু সুন্দরবনের প্রবেশ করতে হলে বনদস্যুদের মুক্তিপণের টাকা নিয়ে ঢুকতে হবে। এ জন্য যেতে পারছি না। দাদনের টাকা দিয়ে সংসার চালাচ্ছি। চিন্তাভাবনা করছি বনদস্যু নির্মূল না হলে অন্য কোথাও গিয়ে কাজ করে দাদনের টাকা শোধ করব।

সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, সুন্দরবনের নতুন করে বনদস্যু ফিরে আসায় জেলেদের বনে প্রবেশ কমে গেছে। সুন্দরবন ছেড়ে তারা অন্য কোথাও কাজের উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছে। সুন্দরবনে বনদস্যু নির্মূল করতে বন বিভাগের টহল বাড়ানো হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হবে। অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে বনদস্যুদের লোকেসন ট্র্যাক করা খুব কষ্টের।

শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে সুন্দরবনে বনদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। আমরা সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করব। যাতে জেলেরা বনদস্যুর কাছে হয়রানির শিকার না হয়। ওপর থেকে যারা বনদস্যুদের সহযোগিতা করছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।