দেশের ৮ স্থলবন্দর বন্ধের পথে
সারাদেশে বর্তমানে ২৪টি স্থলবন্দর আছে। আমদানি-রপ্তানির স্বার্থে এসব স্থলবন্দর ঘোষণা করা হলেও অনেকটি অপারেশনে আসেনি। কিছু ঘোষণা করা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। বাড়ির পাশে একটি স্থলবন্দর দরকার- এমন বিবেচনায় কয়েকটির নাম ঘোষণা করা হয়। এমন অন্তত ৮টি অলাভজনক স্থলবন্দর বন্ধের কথা ভাবছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর আগে সেগুলোর কার্যকারিতা পর্যালোচনায় কমিটি করা হয়েছে। ওই কমিটির প্রতিবেদনের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। বিদ্যমান স্থলবন্দরগুলোর আমদানি-রপ্তানি ও লাভ-লোকসান বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্তের ঘোষণা আসতে পারে।
এ বিষয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল জানান, অনেকটি স্থলবন্দর রয়েছে, যা এখনও অপারেশনে আসেনি। অপ্রয়োজনীয় হলেও কিছু করা হয়েছে স্থানীয় বা রাজনৈতিক বিবেচনায়। সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আবার কিছু আছে যেখানে ইনভেস্ট (বিনিয়োগ) হয়ে গেছে। এখন করণীয় কী তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, স্থলবন্দরগুলোর কার্যকারিতা পর্যালোচনায় একটি কমিটি করা হয়েছে। যেমন- ‘বিরল’, ‘বাল্লা’ এ রকম কিছু স্থলবন্দর রয়েছে যেগুলো সত্যিকার অর্থে চালুই হয়নি। এগুলোর আদৌ প্রয়োজন আছে কি না তা ভাবার বিষয়। আবার চাইলেই কিছু স্থলবন্দর বন্ধ করা যাচ্ছে না। শুল্ক স্টেশন রয়েছে। তাই বাস্তবে কী করণীয় এসব নিয়ে কমিটির প্রতিবেদন সাপেক্ষে পদক্ষেপ নেবে মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, বাংলাদেশের স্থলসীমান্তের মোট দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ২৪৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে ভারতের সীমান্ত এলাকার দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ৫৩ কিলোমিটার। মিয়ানমারের সঙ্গে আরও ১৯৩ কিলোমিটার আছে। এই স্থলসীমান্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ভূমিকা রাখছে। ২০০২ সালে স্থলবন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের (বাস্থবক) অধীনে ২৪টি শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর ঘোষণা করে সরকার। ১৫টি শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর হিসেবে অবকাঠামো করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি স্থলবন্দর যেমনÑ বেনাপোল, বুড়িমারী, আখাউড়া, ভোমরা, নাকুগাঁও, তামাবিল, সোনাহাট, গোবড়াকুড়া-কড়াইতলী, বিলোনিয়া, শেওলা এবং ধানুয়া কামালপুর স্থলবন্দর পরিচালিত হচ্ছে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। আর বাংলাবান্ধা, সোনামসজিদ, হিলি, টেকনাফ ও বিবিরবাজারÑ এই ৫টির অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য বিওটিভিত্তিতে (বিল্ড-অপারেটর-ট্রান্সফার) পোর্ট অপারেটর নিয়োগ করা হয়েছে। বাল্লা, রামগড়, ভোলাগঞ্জ, বিরল, দর্শনা, দৌলতগঞ্জ, তেগামুখ ও চিলাহাটিÑ এই ৮টির উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান এবং কিছু চালুর অপেক্ষায়।
গত ৬ নভেম্বর নৌপরিবহন উপদেষ্টার নির্দেশে ৮টি অলাভজনক ও কার্যক্রমহীন স্থলবন্দরের কার্যকারিতা যাচাইয়ে ৬ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। নৌ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবকে (বাস্থবক) আহ্বায়ক করে গঠিত ওই কমিটিতে অর্থ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগসহ বিভিন্ন সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের রাখা হয়েছে। স্থলবন্দরগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করে মতামতসহ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এখনও কমিটির কাজ চলছে বলে গতকাল জানিয়েছেন নৌ উপদেষ্টা। যেসব স্থলবন্দরের ব্যাপারে বলা হয়েছে সেগুলো হচ্ছেÑ ১. নাকুগাঁও স্থলবন্দর, নালিতাবাড়ি, শেরপুর, ২. গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর, হালুয়াঘাট, ময়মনসিংহ, ৩. ধানুয়াকামালপুর স্থলবন্দর, বকশিগঞ্জ, জামালপুর, ৪. বাল্লা স্থলবন্দর, চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ, ৫. বিল স্থলবন্দর, দিনাজপুর, ৬. চিলাহাটি স্থলবন্দর, ডোমার, নীলফামারী, ৭. দৌলতগঞ্জ স্থলবন্দর, জীবননগর, চুয়াডাঙ্গা ও ৮. তেগামুখ স্থলবন্দর, বরকল, রাঙ্গামাটি।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের বর্তমান অনুমোদিত জনবল ৪৯০। কর্মরত পদ ৪০৭টি। স্থলবন্দরের উন্নয়নে অনেক প্রকল্প চলমান। বেনাপোল স্থলবন্দরে কার্গো ভেহিক্যাল টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি শেষ হয়েছে গত জুনে। বাংলাদেশ রিজিওনাল কানেকটিভিটি প্রজেক্ট- শেওলা, রামগড় ও ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দর উন্নয়ন এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পটি চলমান। এ প্রকল্পের আওতায় শেওলা স্থলবন্দরে ১৫০ গজের মধ্যে অবশিষ্ট নির্মাণকাজ নতুন একটি প্যাকেজের মাধ্যমে চলছে। বেনাপোল স্থলবন্দরের নিরাপত্তা প্রাচীর চলতি মাসের মধ্যে শেষ করার কথা। রামগড় স্থলবন্দরে সাময়িক ব্যবস্থা হিসাবে ১২ হাজার বর্গফুটের প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর চালু করতে ২টি প্যাকেজের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নিয়োগ চূড়ান্ত করে সাইট হস্তান্তর হয়েছে। ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের দুটি প্যাকেজের ঠিকাদার নিয়োগ চূড়ান্ত করে কার্যক্রম চলমান। ‘ডিজিটাইলাইজেশন অব দ্য বর্ডার প্রসিডিউরস অ্যাট ভোমরা ল্যান্ড পোর্ট’ প্রকল্পটি ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। এ ছাড়া আখাউড়া এবং তামাবিল স্থলবন্দরের উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান পৃথক প্রকল্পের মাধ্যমে। গত দুই যুগ ধরে স্থলবন্দরের উন্নয়নে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে। এ পর্যন্ত ঘোষিত ২৪ স্থলবন্দরের মধ্যে অনেকগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিনা প্রয়োজনে কিংবা সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া নির্মিত স্থলবন্দরে বিনিয়োগের পর এখন আলোচনা বন্ধের পর কী কাজে আসবে? জমি অধিগ্রহণসহ অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ শেষে এখন আলোচনা এগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে।
এদিকে দেশের প্রধান স্থলবন্দরগুলো দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম প্রায় স্বাভাবিক রয়েছে। ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত ভিসা দেওয়া বন্ধ রাখায় স্থলবন্দরগুলোর ইমিগ্রেশন দিয়ে দুই দেশের মধ্যে যাত্রী পারাপার কমেছে। আমদানি-রপ্তানি বন্ধ একাধিক শুল্ক স্টেশনের।