বাড়িভাড়া বৃদ্ধি ঠেকাবে কে

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বাড়িভাড়া বৃদ্ধি ঠেকাবে কে

ঢাকায় কত শতাংশ মানুষের নিজের ঘর রয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই কোনো সংস্থার কাছেই। তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, ঢাকায় প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের নিজস্ব ঘর নেই। বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ভাড়া বাসায় থাকেন। আর ৩০ শতাংশ মানুষ যাদের নিজ ঘর রয়েছে, তাদের খেয়াল-খুশির ওপর নির্ভর করে ভাড়াটিয়াদের জীবন-মান। প্রতিবছর নানা অজুহাতে বাড়ির মালিকরা ভাড়া বাড়িয়ে থাকেন। অন্য বছরের মতো এবারও নতুন বছরের শুরুতে ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ জারি করেছেন বাড়ির মালিকরা। একদিকে দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে নতুন করে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ মারাত্মক অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে ভাড়াটিয়াদের। যদিও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির তাপ বাড়ির মালিকদেরও পোড়াচ্ছে।

বছরের শুরুতে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছেন অনেক বাড়ির মালিক। আইন অনুযায়ী, প্রতি দুই বছর পর বাড়িওয়ালারা চাইলে মানসম্মত পর্যায়ে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি করতে পারবেন। তবে সেই আইন বাস্তবায়ন করবে কোন সংস্থা, তার কোনো দিকনির্দেশনা নাই। ফলে আইনের প্রয়োগ হয় না। আর এই সুযোগে বাড়িওয়ালারা খেয়াল-খুশিমতো ভাড়া বৃদ্ধি করে থাকেন। ঢাকায় বসবাস করা ৭০ শতাংশ মানুষের যেখানে নিজ ঘর নেই, সেই শহরে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের অধিকার সংরক্ষণে এখনও কার্যকর কোনো আইন নেই। কাগজে-কলমে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন করা হলেও সেটি বাস্তবায়নকারী সংস্থা বা মন্ত্রণালয় আজও ঠিক হয়নি। ফলে কাগুজে আইনে বন্দি ভাড়াটিয়াদের অধিকার।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) তথ্যমতে, রাজধানীতে ৩০ শতাংশ মানুষের নিজের ঘর আছে। এ হিসাবে শেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, রাজধানীর জনসংখ্যা ২ কোটি ১০ লাখ ধরলে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ নিজস্ব আবাসনের বাইরে রয়ে গেছেন।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে বলে জানা গেছে, সর্বনিম্ন ১ হাজার থেকে ৫ হাজার পর্যন্ত বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছেন বাড়ির মালিকরা। প্রতিবছর ১০ থেকে ২০ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া বাড়ানো হয় বলে জানা গেছে। তবে আইনে আছে প্রতি দুই বছর পর বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়া বাড়াতে পারবেন, তবে তা হবে যুক্তিসঙ্গত। অর্থাৎ, বাড়িওয়ালা একবার ভাড়া বাড়ালে দুই বছরের আগে ভাড়া আর বাড়াতে পারবেন না।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, যারা ভাড়া থাকেন তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই বাড়া বৃদ্ধিটা জুলুম হয়ে যায়। তবে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভাড়া বৃদ্ধি করলে সেটা যৌক্তিক বলেই মনে করি। অনেক বাড়ির মালিক রয়েছেন, যাদের একমাত্র আয় বাড়ি ভাড়া থেকে। ফলে মূল্যস্ফীতির চাপে তাদেরও ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি যৌক্তিক। সেটা হতে হবে অবশ্যই দুই পক্ষের চাহিদা ও সক্ষমতার ভিত্তিতে।

ভাড়াটিয়াদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে ‘ভাড়াটিয়া পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন। এই সংগঠনের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার আমাদের সময়কে বলেন, ভাড়াটিয়াদের চাপ বাড়ির মালিকরা বুঝতে চান না। দ্রব্যমূল্য যে হারে বেড়েছে, সেটা সামাল দিতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে, নতুন করে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি জুলুম করা হবে। আমাদের সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ করেছেন। তারা বলেছেন, ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। আইনে যেখানে সুস্পষ্ট বলা রয়েছে, দুই বছরে একবার ভাড়া বৃদ্ধি করার কথা, সেখানে বাড়িওয়ালারা প্রতিবছর ভাড়া বৃদ্ধি করেন। এটা আইনে থাকলেও দেখার কেউ নাই।

তবে বাড়ির মালিকরা বলছেন, তারা নিরুপায়। রাজধানীর মিরপুর পল্লবীর বাড়ির মালিক আবু হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, সারাজীবনের জমানো টাকা দিয়ে একটা বাড়ি বানিয়েছিলাম। চাকরি থেকে অবসরে আসার পর আয় বলতে এই বাড়ি ভাড়া। নিজের সংসার চালানো, সন্তানদের খরচও এখন ভাড়ার টাকা থেকে দিতে হয়। সব জিনিসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদেরও বাজারে যেতে হয়। ভাড়াটিয়াদের যেমন কষ্ট হয়, আমাদেরও কষ্ট কম না। তবে আমি জুলুম করি না। বছরে ১ হাজার টাকা করে বৃদ্ধি করি।

ভাড়া বৃদ্ধির কারণে অনেকে বাসা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম টাকার বাসা খোঁজেন। প্রতিবছর নভেম্বর-ডিসেম্বর এলে অনেকেই শুধু এ কারণেই বাসা বদলান। তেমন একজন বনশ্রীর মোহাম্মদ আলী। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, অক্টোবর মাসে বাড়িওয়ালা নোটিশ দিয়েছে, জানুয়ারি থেকে ২ হাজার টাকা ভাড়া বাড়বে। আমার সন্তানের স্কুল, সংসার খরচ সব মিলিয়ে দুই হাজার টাকা মাসে অতিরিক্ত খরচ আমি চালাতে পারব না। তাই একটু নিম্ন এলাকায় বাসা নিয়েছি। প্রতিবছরই ভাড়া বাড়ে। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করবে কে? এখানে কোথাও কোনো অভিযোগ দেওয়ার সুযোগ নেই। সমাধানও নেই।

বাড়ি ভাড়ার খরচ বেশি ঢাকার শহরে থাকা মেস বাসাগুলোতে। তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড়ে মেস বাসায় থাকেন সিফাত হোসেন। সাউথইস্ট বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র সিফাত ও তার চার বন্ধু মিলে দুই রুমের একটি বাসায় থাকেন। গত বছর সে বাসার ভাড়া ছিল ১২ হাজার। এবার এক লাফে ১৫ হাজার করার নোটিশ দিয়েছে বাড়িওয়ালা। এখন অন্য জায়গায় মেস খুঁজেও পাচ্ছেন না। সব জায়গায় বাড়তি ভাড়া।

সিফাত হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, বাড়ি থেকে প্রতিমাসে একটা নির্দিষ্ট টাকা দেয়। প্রতিবছর মেস খরচ বেড়ে যাওয়ায় খাবারের মেনু কাটছাঁট করতে হয়। এমনিতে মেসজীবন কষ্টের। তার ওপর এমন ভাড়াবৃদ্ধিতে লেখাপড়া চালানো কষ্টকর।