কেরামত আলীর কেরামতি স্ত্রী হন কোটিপতি

অনুসারীরা হয়েছেন আঙুল ফুলে কলাগাছ

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
কেরামত আলীর কেরামতি স্ত্রী হন কোটিপতি

রাজবাড়ী-১ (সদর-গোয়ালন্দ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলহাজ কাজী কেরামত আলী পৈতৃক সূত্রে সম্পদশালী হলেও এমপি হয়ে কামিয়েছেন দুই হাত ভরে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় নিয়োগ বাণিজ্য, টিআর, জিআর, কাবিখা, কাবিটার অর্থ আত্মসাৎ এবং এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, গণপূর্ত, হাসপাতালসহ সব সরকার দপ্তরের প্রকল্পে কমিশন বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই কেরামত আলীর কেরামতিতে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন আরও অনেকেই। রাতারাতি পাল্টে গেছে তাদের চালচলন। তবে সব কিছু ছাড়িয়ে গেছে তার স্ত্রী রেবেকা সুলতানার সম্পদ বৃদ্ধির গল্প। রীতিমতো স্ত্রীর হাতে আলাদিনের চেরাগ তুলে দিয়েছিলেন কাজী কেরামত।

২০২৩ সালের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পাঁচ বছরের ব্যবধানে কাজী কেরামত আলীর সম্পদ তুলনামূলক কমেছে, যদিও তা কমিয়ে দেখানো হয়েছে বলেছেন স্থানীয়রা। তবে এ সময় তার তুলনায় স্ত্রীর সম্পদ রীতিমতো ফুলে ফেঁপে ওঠে। ২০১৮ সালের হলফনামায় যেখানে স্ত্রী রেবেকা সুলতানার কোনো বার্ষিক আয় উল্লেখ ছিল না, সেখানে ২০২৩ সালে তার বার্ষিক আয় দেখানো হয় ৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা। একইভাবে রেবেকার আয় দেখানো হয় ৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এ ছাড়া তার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ৪৭ লাখ টাকা, সঞ্চয়পত্রে ২৫ লাখ টাকা দেখানো হয়। পাঁচ বছরের ব্যবধানে রেবেকার তিন লাখ টাকা মূল্যের প্রাইভেট কারের জায়গায় স্থান পায় ৪৪ লাখ টাকা মূল্যের একটি জিপ গাড়ি ও ২৭ লাখ টাকার একটি মাইক্রোবাস। এ সময় কেরামত আলী ও স্ত্রী রেবেকা সুলতানা উভয়ের নামে ঢাকা উত্তরা মডেল টাউনে সাততলা দালান কেনা হয়েছে। এ ছাড়াও কেরামত আলী মুলঘর ইউনিয়নের বারবাকপুরে বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তুলেছেন মৎস্য ও মুরগির খামার। গোয়ালন্দ, রাজবাড়ীতে নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি, গাড়ি-বাড়িসহ সম্পদের পাহাড়। ২০১৮ সালের হলফনামায় উল্লেখ না থাকলেও ২০২৩ সালের হলফনামায় দেখা গেছে, পাঁচ বছরের ব্যবধানে স্ত্রী রেবেকা ঢাকা রমনা ওয়ালসো টাওয়ার ১৬৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, বারিধারায় ২৭০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে,

রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের চরনারায়ণপুর গ্রামের রমজান সরদারের ছেলে রাজু সরদারকে টাকা নিয়ে চাকরি না দেওয়ায় ক্ষোভে ও অভিমানে আত্মহত্যা করে। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এমপির কারণেই আত্মহত্যা করে বলে এলাকায় চাউর হয়।

রাজবাড়ী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী তার দলীয় পদটি ছোট ভাই কাজী ইরাদত আলীকে লিখে দেন। কেরামত আলী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সেই পদই ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে ভাইকে লিখে দেন তিনি। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ঘটনা ঘটে। সংসদ সদস্য পদে দলীয় মনোনয়ন চাওয়ার হুমকি দিয়ে ইরাদত আলী ভাইয়ের ওপর চাপ তৈরি করেন। তিনি তখন জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দলীয় মনোনয়নে ছোট ভাই যাতে বাগড়া দিতে না পারেন সে জন্য নিজের পদ লিখে দেন কেরামত আলী।

অভিযোগ রয়েছে- স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম প্রহরী নিয়োগ বাণিজ্যে মেতেছিলেন কাজী কেরামত আলী। তার নির্দেশ ছাড়া কোনো নিয়োগ হয়নি ১৫ বছরে। পছন্দের লোক এবং তার কথা ছাড়া নিয়োগ করতে গেলেই বেধেছে বিপত্তি। শুধু তাই নয়, কেরামতের মনোনীত লোক ছাড়া কেউ স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি পর্যন্ত হতে পারেননি। তার কথাই ছিল শেষ কথা। এ ছাড়া পদ্মা নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে বালু উত্তোলন, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, বিভিন্ন সরকারি অফিস থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন নেওয়া, নদীশাসন কাজের ভাগবাটোয়ারা করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে নিজের মেয়েকে পিএস বানিয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসেন কাজী কেরামত। পরে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটের তৎকালীন গডফাদার প্রয়াত নুরু মণ্ডলসহ সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে কক্সবাজার ভ্রমণে গিয়ে আরেক আলোচনার জন্ম দেন। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে থেকে জমি ক্রয়ের নামে রেজিস্ট্রি করে নিলেও তাদের কোনো টাকা-পয়সা দেওয়া হয়নি। তার ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইরাদত আলীর সঙ্গে বিরোধের কারণে পাশেই একটি বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন কেরামত।

কেরামত আলীর কেরামতিতে তার অনেক অনুসারী আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন। তোফাজ্জল হোসেন তপু তাদের একজন। দৌলতদিয়া পতিতা পল্লীর জুয়ার নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। এই আখড়াগুলোতে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা জুয়া খেলা হতো। পতিতালয়ে রয়েছে তার কয়েকটি বাড়ি। যৌন পল্লীতে খড়গুটি, চরকি ও তিন তাসের জুয়ার আসরসহ মাদক বিক্রি ও সেবন নিয়ন্ত্রণ করতেন তপু। এ সুবাদে পল্লীর ভেতরে যত্রতত্র খড়গুটি, চরকি ও তিন তাসের জুয়া জমজমাট চলতো রাত-বিরাত। এ জুয়ার টাকা রাতের বেলা বস্তা ভরে পল্লী থেকে নিয়ে যেত তার লোকজন। এর থেকে মোটা অঙ্কের ভাগ পেতেন এমপি কাজী কেরামত। দৌলতদিয়া, গোয়ালন্দে রয়েছে তপুর আলিশান বাড়ি। তার রয়েছে বেশ কয়েকটি ডাম্প ট্রাক, ভেকু, মাইক্রোবাস। তার বিরুদ্ধে রয়েছে জমি দখলের অভিযোগও।

১৯৯৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সাবেক এমপি কাজী কেরামত আলীর কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে ওহাব নামে তার এক অনুসারী গড়ে তুলেছেন ২ কোটি টাকার দুটি ভবন। বাড়ির আশপাশে ১৫ কোটি টাকা মূল্যের অন্তত ১০ বিঘা জমি ক্রয় করেছে। ২০ কোটি টাকা মূল্যের শহরের রাজ্জাক স্টোরের সামনে মার্কেট, শহরের উপকণ্ঠে ভাজন চালায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের নির্মিত চারতলা বিল্ডিং, ঢাকার উত্তরায় ৫ তলা বাড়ি রয়েছে। রাজবাড়ী খাদ্য গুদামের দরপত্র ছাড়া কাজ বাগিয়ে নেওয়া এবং এমপির নাম ভাঙিয়ে মৌসুমের ধান, চাল বিক্রি কেনাকাটা এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন ওহাব।

বিষ্ণুপদ মিত্র ছিলেন কাজী কেরামত আলীর বাসার কর্মচারী। তার বাবাও কর্মচারী ছিলেন। সেই সুবাদে এমপির ছত্রছায়ায় নানা অপকর্ম করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বিষ্ণু। তার নামে-বেনামে অনেক ডিলারশিপের ব্যবসা রয়েছে। এ ছাড়াও রাজবাড়ীর কুটিরহাট, মুলঘর, গোয়ালন্দ মোড়, সূর্যনগর এলাকায় শত বিঘা জমি রয়েছে বিষ্ণুর নামে। তাদের মতো আরও বেশ কয়েকজন এমপির ছত্রছায়ায় গড়ে তুলেছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ।

গত ৫ আগস্ট সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলহাজ¦ কাজী কেরামত আলী সপরিবারে গা-ঢাকা দিয়েছেন। তার সাঙ্গোপাঙ্গরাও রয়েছেন আত্মগোপনে। এ কারণে তাদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।