বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে হাসিনায় অস্বস্তি
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটতে থাকে। এই টানাপোড়েনের মধ্যেই গত ৯ ডিসেম্বর ঢাকা সফরে আসেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। সদ্য সমাপ্ত এই সফর নিয়ে গত বুধবার ভারতের বিরোধী দলীয় এমপি শশী থারুর নেতৃত্বাধীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে ব্রিফ করেন তিনি। সেখানে বিক্রম মিশ্রি বলেন, ভারতে বসে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনার বিষয়টি সমর্থন করে না নরেন্দ্র মোদি সরকার। তার কথাবার্তা দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘অস্বস্তির কারণ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও জানান মিশ্রি। খবর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুর।
গত সোমবার ঢাকায় ‘ফরেন অফিস কনসালটেশন-এফওসি’ শীর্ষক পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়। এতে বিক্রম মিশ্রি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। এফওসি বৈঠকের পর বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গেও বৈঠক করেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ‘কোনো একক রাজনৈতিক দল’ বা একটি সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় জানিয়ে ব্রিফিংয়ে বিক্রম মিশ্রি বলেন, ভারত ‘বাংলাদেশের জনগণের’ সঙ্গে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেয় এবং যে কোনো সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে। শেখ হাসিনা তার মন্তব্যের জন্য ‘ব্যক্তিগত যোগাযোগ ডিভাইস’ ব্যবহার করছেন জানিয়ে বিক্রম মিশ্রি বলেন, ভারতের মাটিতে বসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারেন, এমন কোনো প্ল্যাটফর্ম বা সুবিধা ভারত তাকে দেয়নি। এটি তৃতীয় কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ না করার ঐতিহ্যগত রীতির অংশ।
গত কয়েকদিনে ভারতে বসে শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে বেশ কয়েকটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন। তার এমন রাজনৈতিক কার্যক্রম ভালোভাবে নেয়নি বাংলাদেশ সরকার। এমন পরিস্থিতিতে হাসিনাকে নিয়ে বিক্রম মিশ্রির বক্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছে দ্য হিন্দু।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বাণিজ্য ও যোগাযোগের বৃহত্তম অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করে বিক্রম মিশ্রি বলেন, সাম্প্রতিক বছরে দুই দেশ রেল যোগাযোগ, বাস সংযোগ, অভ্যন্তরীণ নৌপথ নির্মাণ করেছে। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে যাত্রীবাহী রেল সেবা স্থগিত রয়েছে। তবে তার সফরের পরে দুই দেশের সম্পর্কের স্পষ্ট উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার বিষয়ে বিক্রম মিশ্রি বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার অভিযোগের স্বীকৃতির নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন ছিল। তবে সবশেষ খবর হলো, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে এ-সংক্রান্ত সহিংসতার ঘটনায় ৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ। এ খবরকে ভারত স্বাগত জানায়।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত হামলা ও নির্যাতনের খবর অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যা ও ভুয়া তথ্যও প্রচার করছে। বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফরে এসব অপতথ্য প্রচারের বিষয়টি তুলে ধরেছে বাংলাদেশ। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলোকে অতিরঞ্জন বা গণমাধ্যমের বানানো হিসেবে বর্ণনা করলেও এ নিয়ে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ কিছু সংস্থা কিছু ঘটনা নথিভুক্ত করেছে যেগুলোকে যাচাই করা দরকার।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
বিক্রম মিশ্রি উল্লেখ করেন, এ ধারায় কথাবার্তা বলার পর বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সেখানে তিনি সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা জানান। তিনি আরও জানান, কিছু হামলার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, সেগুলো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা। তবে এ ধরনের যুক্তি এই ধরনের হামলাকে ন্যায্যতা দিতে পারে না বলে মনে করনে মিশ্রি।
বুধবারের ব্রিফিংয়ে বেশ কয়েকজন ভারতীয় সংসদ সদস্য বাংলাদেশের মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি নিয়েও বিক্রমকে প্রশ্ন করেন। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব তাদের আশ্বস্ত করেন যে বাংলাদেশ সরকার অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ ছাড়া, অনেকে বাংলাদেশে ইসকন নেতাদের গ্রেপ্তারের বিষয়টিও ব্রিফিংয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে বিক্রম মিশ্রির কাছ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। বিক্রম মিশ্রি অবশ্য পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বলেছেন, ঢাকা সফরকালে তিনি বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন, বিভিন্ন মন্দির ও ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে হামলার ঘটনা স্বীকার করা দরকার।
পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে বিক্রম মিশ্রি জানান, ঢাকা সফরকালে তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি ‘গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বাংলাদেশের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বিক্রম মিশ্রি বলেন, গত বছর বাংলাদেশিদের জন্য ১৬ লাখ ভিসা ইস্যু করে ভারত। এই সময়ে বাংলাদেশিদের জন্য সবচেয়ে বেশি ভিসা ইস্যু করেছে ভারত। বিক্রম মিশ্রি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘পারস্পরিক সম্পর্ক’-এর ভিত্তি হিসেবে দেখে না ভারত, বরং ‘ভালো প্রতিবেশী সম্পর্কের’ ভিত্তি হিসেবে দেখে। ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি পর্যালোচনার বিষয়টি নিয়ে কথা হয়নি বলে জানান পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে বিক্রম মিশ্রি।