নারীপ্রধান সিনেমা কমে যাচ্ছে

ফয়সাল আহমেদ
১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
নারীপ্রধান সিনেমা কমে যাচ্ছে

নারীপ্রধান সিনেমাগুলো সবসময়ই বাণিজ্যিকভাবে সফল। তবে এই শিল্পে নারী-পুরুষের বৈষম্য রয়েই গেছে। বেশিরভাগ গল্পই হয় পুরুষনির্ভর। নারীকে বেশিরভাগ সিনেমাতেই দুর্বলভাবে উপস্থাপন করা হয়; কিন্তু সিনেমায় নারীচরিত্র একটি অপরিহার্য অংশ। নব্বই দশক পর্যন্ত নারীপ্রধান সিনেমার সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য। বর্তমান সময়ে এসে বাণিজ্যিক ধারার সিনেমায় নারীচরিত্র উপেক্ষিত বলেই দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। নারীপ্রধান সিনেমার মধ্যে রয়েছে সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, হূমায়ুন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’, প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘ভাত দে’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘সখিনার যুদ্ধ’, ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’, ‘গোলাপী এখন বিলেতে’। নারীকে উপজীব্য করে নির্মাণ করা হয়েছে আরও অনেক সিনেমা, যা এখনও দর্শক-হৃদয়ে স্থান করে আছে। তবু বাণিজ্যিক চিন্তায় নারীনির্ভর সিনেমা বানাতে খানিক চিন্তিত হচ্ছেন পরিচালকরা। ‘সারেং বৌ’, ‘শাস্তি’, ‘সুভা’, ‘সূর্যকন্যা’, ‘তিন কন্যা’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘ফুলশয্যা’, ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’, ‘আলোর মিছিল’, ‘মেঘের অনেক রং’, ‘আম্মাজান’, ‘ধর’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’, ‘চার সতীনের ঘর’, ‘মেঘের কোলে রোদ’, ‘মেঘলা আকাশ’, ‘অবুঝ বউ’, ‘পুত্র এখন পয়সাওয়ালা’, ‘পৌষ মাসের পিরিত’-এর মতো সিনেমাকে উদাহরণ হিসেবে দেখালে এখানে ভয়ের কোনো কারণ আছে বলে মনে করছেন না সিনেমা বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া বিগত কয়েক বছরে নির্মাণ করা হয় ‘যৌবতী কন্যার মন’, ‘দেবী’, ‘বিশ্বসুন্দরী’, ‘ন ডরাই’ প্রভৃতি। এ ছাড়া রয়েছে ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’, ‘বিরাজ বৌ’, ‘পালাবি কোথায়’, ‘নিরন্তর’, ‘গেরিলা’, ‘মায়াবতী’, ‘সুতপার ঠিকানা’র মতো নারীবাদী সিনেমা। তবু এখন নারীকে উপেক্ষা করেই নির্মাণ করা হচ্ছে সিনেমা।

বিষয়টি নিয়ে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা আফরান নিশো বলেন, ‘আমাদের দেশে নারীকেন্দ্রিক গল্পের কাজ কম হয় এবং হলেও সেটাতে অনেকেরই আগ্রহ কম থাকে। শুধু তা-ই নয়, পরিচালকরাও খুব বেশি আগ্রহ নিয়ে করেন না। আমার মনে হয় এটা ঠিক নয়। পুরুষদের যেমন আবেগ-অনুভূতি, সমস্যা বা ভালোলাগা আছে তেমনি নারীদেরও আছে। তাদের নিয়ে কেন পর্দায় কাজ হয় না? আমি মনে করি এ ধরনের কাজ হওয়া জরুরি এবং এমন কাজের সঙ্গে আমার যদি যুক্ত থাকার কোনো সুযোগ থাকে, তা হলে অবশ্যই থাকব।’ অভিনেত্রী জাকিয়া বারি মম বলেন, ‘আমি যদি আমার কথাই বলিÑ যেসব সিনেমায় কাজ করি, সেখানে গল্পগুলো পুরুষকেন্দ্রিক। বেশিরভাগই পুরুষকেন্দ্রিক। এখানে নারীচরিত্রের উপস্থিতি ও গুরুত্ব কম। এর নানামুখী কারণ হয়তো আছে। তবে আমি চাই এই জায়গায় পরিবর্তন আসুক। সিনেমায় নারীপ্রধান গল্প হোক। কিছু ওয়েব সিরিজ, সিনেমায় এখন সেটা হচ্ছে বটে। নারীরা যে বড় শক্তি, এ সময়ে এসে তা এখন আর অস্বীকার করার সুযোগ নাই। নারীর জীবনে এত এত রঙ আছে, তাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতাÑ এসব নিয়েও কাজ করা যায়।’

এ প্রসঙ্গে কাজী হায়াৎ বলেন, ‘ঢালিউডে নারীপ্রধান চরিত্র নিয়ে সিনেমা নির্মাণ তেমনভাবে হয়নি। কারণ সমাজে নারীদের বিচরণ ও কর্ম ছিল সীমিত। সমাজের নানা কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণও কম ছিল। আগে নারীদের ভাবা হতো শুধুই গৃহবধূ। তারা চার দেয়ালের মধ্যেই বন্দি থাকবেÑ এমনই ছিল মানসিকতা। এখন সময়ের বিবর্তনে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। নানা সেক্টরে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ছে। নারীদের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে। তাই এখন সময় এসেছে নারীপ্রধান সিনেমা নির্মাণের।’ বিষয়টি নিয়ে প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুচন্দা বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীরা সব সময়ই উপেক্ষিত। নারীদের আনন্দ-বঞ্চনা নিয়ে সিনেমা নির্মাণ নারীদের হাতেই যথাযথভাবে ফুটে ওঠে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের সিনেমাশিল্পে নারী নির্মাতাদের অংশগ্রহণ কম।’ ববিতা বলেন, ‘নারী হিসেবে আমি যখন সিনেমা নির্মাণ করি তখন তাতে নারীদেরই প্রাধান্য দেই। অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা, গবেষণা আর নির্মাতাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কম বলেই বর্তমানে নারীপ্রধান সিনেমা নির্মাণ তেমনভাবে আর হয় না। আসলে নারী ও পুরুষ একে অন্যের পরিপূরকÑ এ ভাবনাটি যতক্ষণ পর্যন্ত দেশ ও সমাজে প্রতিষ্ঠা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত নারী অবহেলিতই থেকে যাবে।’ নারীপ্রধান একাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন জয়া আহসান। তিনি বলেন, ‘আমাদের সিনেমায় নারী অবয়ব বেশির ভাগ সময়ই অস্পষ্ট ছিল। কিছু নারীকেন্দ্রিক ভালো কাজ যে হয়নি, তা নয়। হয়েছে; কিন্তু তা সংখ্যায় খুবই কম। বিশ্বজুড়ে নারীকেন্দ্রিক সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে; কিন্তু তার পরও আমরা বেশির ভাগ সিনেমা দেখি পুরুষপ্রধান। এর মূল কারণ হতে পারে নির্মাতাদের ভাবনা। অনেকে ধরেই নেন, নারীপ্রধান চরিত্রের সিনেমাগুলো দর্শক সেভাবে গ্রহণ করবেন না, কিংবা বাণিজ্যিক সফলতা পাবে না। এ ধারণা সব সময় সত্য বলে প্রমাণ হয়নি। নারীপ্রধান সিনেমা নির্মাণের বিষয়ে একটু আলাদা করে ভাবার সময় এসেছে।’ পপি বলেন, ‘একজন নারী খুব সময়ই নিজের জন্য ভাবার সময় পান। পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের নিয়ে ভাবতে হয় তাকে। রাতে ঘুমানোর আগেও সকালে তার পরিবারের সদস্যরা সকালে ঘুম থেকে উঠে কী খাবেন সেটার প্ল্যান করতে করতে ঘুমাতে যান। পৃথিবীর সব বড় বড় সাফল্য নারী-পুরুষ তো মিলেই এনেছে। তাই নারীকে হেয় করার বা তাকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই। যারা দেখেন তারা মানসিকভাবে অসুস্থ।’