মুক্তিযুদ্ধের গল্পে টিভি নাটক
দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সংগ্রাম আর লাখো প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া গেল একটি মানচিত্র। বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াল সোনার বাংলাদেশ। যুগে যুগে মহান মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা টিভি নাটকে এসেছে বিভিন্নভাবে। টেলিভিশন প্রতিষ্ঠার সাড়ে ছয় বছর পর ১৯৭১ সালে শোষণ ও বঞ্চনার অচলায়তন ভাঙার বিদ্রোহে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে দেশ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই তৎকালীন ঢাকা টেলিভিশনে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানমালায় বিদ্রোহের আবহ ছড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতিপর্বে ১৯৭১ সালের ২১ মার্চ ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় ‘আবার আসিব ফিরে’ নামের একটি নাটক। সৈয়দ মাহমুদ আহমেদের কাহিনিকে নাট্যরূপ দিয়েছিলেন প্রয়াত নাট্যব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আল মামুন। এ নাটকে সরাসরি দেশের জন্য জীবন দিয়ে লড়াই করার আহ্বান জানানো হয়েছিল।
\একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে টেলিভিশনের অনেক কর্মীই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে যারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করেন তাদের মধ্যে জামিল চৌধুরী, মুস্তাফা মনোয়ার, মুস্তাফিজুর রহমান অন্যতম। টেলিভিশনের প্রায় ২০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী পকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। লাহোর টেলিভিশন থেকে কর্মী এনে টিভি সম্প্রচার চালু রাখা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা এক সময় টিভিতে ছোটদের অনুষ্ঠান বা নাটকে অংশ নিয়েছেন, সেই সব গেরিলারা ডিআইটি ভবনের টিভি টাওয়ারে বোমা বিস্ফোরণ ঘটান। গেরিলাদের মধ্যে ছিলেন মাহবুব আলী, নজিবুল্লাহ, আহসান নেওয়াজ বাবু প্রমুখ। টিভি ভবনে এত নিরাপত্তার পরও বোমা বিস্ফোরণে স্তম্ভিত হয়ে যায় পাকিস্তানি শাসকরা।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের পর পরই একদল মুক্তিযোদ্ধা টিভি ভবনে প্রবেশ করেন। সেখানে ছিলেন প্রয়াত শাহাদাত চৌধুরী, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, রাইসুল ইসলাম আসাদসহ আরও অনেকে। ১৭ ডিসেম্বর টিভি স্ক্রিনে ভেসে ওঠে নতুন টেলপ ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত প্রথম নাটকটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, নাম ‘বাংলা আমার বাংলা’। ড. ইনামুল হকের লেখা এ নাটকটি নির্মাণ করেছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। ১৯৭২-এর মধ্যবর্তী সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত একটি আলোচিত মুক্তিযুদ্ধের নাটক ‘জনতার কাছে আমি’। আমজাদ হোসেন রচিত ও মুস্তাফিজুর রহমান পরিচালিত এ নাটকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের চিত্র তুলে ধরা হয় নাটকীয়ভাবে। কাছাকাছি সময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাটক ‘এরা ছিল এধারে’। মোর্শেদ চৌধুরী রচিত এ নাটকটি প্রযোজনা করেন মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ।
আরও পড়ুন:
ওটিটি প্ল্যাটফরম আমার জন্য বেশ লাকি
এতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দেশে অবস্থানরত মানুষের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করার চিত্র তুলে ধরা হয়। সত্তরের দশকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত আরও কয়েকটি নাটক জনপ্রিয়তা পায়। এর মধ্যে রয়েছে- নাজমা জেসমিন চৌধুরীর লেখা ও আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমামের প্রযোজনায় ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, জিয়া আনসারীর ‘কোনো এক কুলসুম’, আতিকুল হক চৌধুরীর ‘কম্পাস’, রাবেয়া খাতুনের ‘বাগানের নাম মালনীছড়া’, জোবেদ খানের ‘একটি ফুলের স্বপ্ন’, রাজিয়া মজিদের ‘জ্যোৎস্নার শূন্য মাঠ’।
আশির দশকেও মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে নির্মিত হয় একাধিক নাটক। প্রতিকূল পরিবেশ, কারিগরি সীমাবদ্ধতা ও কড়া নীতিমালার মধ্যেও প্রযোজকরা অসাধারণ কিছু নাটক নির্মাণ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- আল মনসুর রচিত ও মুস্তাফিজুর রহমান প্রযোজিত ‘নয়ন সম্মুখে তুমি নাই’, মমতাজউদদীন আহমেদ রচিত ও মোস্তফা কামাল সৈয়দ প্রযোজিত ‘এই সেই কণ্ঠস্বর’, হাবিবুল হাসানের রচিত ও আবদুল্লাহ আল মামুন প্রযোজিত ‘আমার দ্যাশের লাগি’, কাজী মাহমুদুর রহমান রচিত ও মুস্তাফিজুর রহমান প্রযোজিত ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’, মমতাজউদদীন আহমেদ রচিত ও আবদুল্লাহ আল মামুন প্রযোজিত ‘একটি যুদ্ধ এবং অন্য একটি মেয়ে’, মামুনুর রশীদ রচিত ও মুস্তাফিজুর রহমান প্রযোজিত ‘খোলা দুয়ার’, সৈয়দ শামসুল হক রচিত, ড. রাজীব হুমায়ুন রচিত ও খ ম হারুন প্রযোজিত ‘নীলপানিয়া’, জুবাইদা গুলশানারা রচিত ও শেখ রিয়াজদ্দিন বাদশা প্রযোজিত ‘সাগর সেচার সাধ’, কাজী মাহমুদুর রহমান রচিত ও আতিকুল হক চৌধুরী প্রযোজিত ‘স্বর্ণতোরণ’, বেগম মমতাজ হোসেন রচিত ও খ ম হারুন প্রযোজিত ‘শুকতারা’, আহমেদ মুসা রচিত ও আতিকুল হক চৌধুরী প্রযোজিত ‘চানমিয়ার নেগেটিভ পজিটিভ’ এবং জিয়া আনসারীর ‘জীবনের অপর পাতায়’।
আরও পড়ুন:
ফের জুটি হলেন মম-শ্যামল
নব্বইয়ের দশকেও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বেশকিছু নাটক প্রচারিত হয়। এর মধ্যে মাহবুব জামিল রচিত ও খ ম হারুন প্রযোজিত ‘অচেনা বন্দর’ নাটকটি বেশ প্রশংসিত হয়। একজন প্রকৌশলীর যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং ফিরে এসে স্ত্রী-সন্তানকে হারিয়ে নিঃস্ব জীবনযাপনের করুণ চিত্র ফুটে ওঠে এতে। ‘স্মৃতি বর্তমান’ নামে শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের ভিন্ন ভিন্ন কাহিনি যোগ করে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধারার নাটক উপহার দেন খ ম হারুন। নব্বই দশকে উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে আরও ছিল- সাইফুল বারী রচিত ও জিয়া আনসারী প্রযোজিত ‘জোনাকী জ্বলে’ এবং আমজাদ হোসেন রচিত ও জিয়া আনসারীর প্রযোজনায় ‘জন্মভূমি’। বিটিভিতে প্রচারিত আরও কিছু নাটক দর্শকের মনে দাগ কেটে আছে। এর মধ্যে রয়েছে- কাজী মাহমুদুর রহমান রচিত ও শেখ রিয়াজউদ্দিন বাদশা প্রযোজিত ‘সন্ধান’, আবদুল্লাহ আল মামুন রচিত ও প্রযোজিত ‘আয়নায় বন্ধুর মুখ’, মামুনুর রশীদ রচিত ও আবদুল্লাহ আল মামুন প্রযোজিত ‘আদম সুরত’, আতিকুল হক চৌধুরী রচিত ও প্রযোজিত ‘পটভূমি পরিচিতি’ ও ‘নীল নকশার সন্ধানে’, সেলিনা হোসেন রচিত ও জিয়া আনসারী প্রযোজিত ‘যাপিত জীবন’, আরেফিন বাদল রচিত ও আলী ইমাম প্রযোজিত ‘ঐ আসে আমীর আলী’, মামুনুর রশীদ রচিত ও মুস্তাফিজুর রহমান প্রযোজিত ‘ধল প্রহর’, জিয়া আনসারীর ‘জীবনের অপর পাতায়’ প্রমুখ।
স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবসের বাইরেও একটা সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে মুক্তিযুদ্ধের অনেক নাটক প্রচার হতো। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বাড়লেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নাটক নির্মাণের সংখ্যা কমতে থাকে। এখন মার্চ কিংবা ডিসেম্বর মাস এলেই টেলিভিশনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের নাটক প্রচার করতে দেখা যায়। এ নিয়ে আবুল হায়াত বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের নাটককে সমৃদ্ধ করেছে। সবচেয়ে বড় কথাÑ নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানাতে হলে এ নিয়ে বেশি বেশি কাজ করা উচিত। কিন্তু দিবস ছাড়া বর্তমানে আমাদের এখানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নাটক নির্মাণ হয় না। নির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যেই আটকে আছে গল্প। প্রেম-ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোনো বিষয় খুব একটা থাকে না এসবে।’ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখন নাটক কম হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে সময় স্বল্পতাকে দায়ী করছেন অনিমেষ আইচ। তার ভাষ্যে, ‘মুক্তিযুদ্ধ একটি গবেষণানির্ভর বিষয়। এ ধরনের গল্প নিয়ে নাটক নির্মাণ করতে হলে অনেক অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে হয়। যদি ২৬ পর্বের একটি মুক্তিযুদ্ধের নাটক আমাকে বানাতে দেওয়া হয়, তা হলে এক বছরের প্রস্তুতি প্রয়োজন। সঙ্গে প্রয়োজনীয় টাকাও দিতে হবে।’ বাজেট স্বল্পতা বড় কারণ উল্লেখ করে সালাউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘যেহেতু এটি ইতিহাসনির্ভর বিষয়, তাই সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে না পারলে সমস্যা। যদি আমরা ’৭১-এ গিয়ে গল্প বলতে চাই, তা হলে সেই সময়কে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হয়। সে ক্ষেত্রে একক নাটকের চেয়ে ধারাবাহিকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প তুলে আনা কিছুটা সহজ। বিষয়টি অনেক কষ্টসাধ্য আর বাজেটের ওপর নির্ভর করে। টিভি নাটকে সেই বাজেট পাওয়া যায় না।’
আরও পড়ুন:
মারা গেলেন পরীমনির নানা