রয়টার্সকে জ্বালানি উপদেষ্টা /
‘আমরা কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীকে ব্ল্যাকমেইল করতে দেব না’
ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে ২৫ বছরের চুক্তি আদালত থেকে বাতিল না হলে যে দামে বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে তা দ্রুত কমাতে চাইবে বাংলাদেশ। গতকাল রবিবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এমনটাই জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেছেন, ‘আমরা কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদককে আমাদের ব্ল্যাকমেইল করতে দেব না।’
জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, ‘যদি চুক্তিতে কোনো অস্বাভাবিকতা থাকে, তবে তা পুনরায় আলোচনা করতে হবে। তবে দুর্নীতি বা ঘুষের মতো অনিয়ম থাকলে চুক্তি বাতিল করতে হবে। উভয় সিদ্ধান্তই আদালতের নির্দেশিত তদন্তের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হবে। ’
তিনি আরও বলেন, ভারতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের কিছু কর অব্যাহতির সুবিধা বাংলাদেশ না পাওয়াসহ কিছু ইস্যু ইতোমধ্যেই আদানিকে জানানো হয়েছে, যা চুক্তি পুনর্বিবেচনার ভিত্তি হতে পারে।
তবে আদানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্নীতির অভিযোগ সরাসরি বাংলাদেশি চুক্তির ওপর প্রভাব ফেলবে না বলে মন্তব্য করেন ফাওজুল কবির খান।
আদানি গ্রুপের চুক্তি নিয়ে এমন এক সময়ে বাংলাদেশ এই অবস্থানের কথা জানাল, যখন আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম আদানির বিরুদ্ধে ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগ এনেছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। কয়েক দিন আগে মার্কিন বিচার বিভাগের অভিযোগে বলা হয়েছে, গৌতম আদানি ২৬৫ মিলিয়ন ডলারের ঘুষ কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিলেন। যদিও আদানি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
তবে এরইমধ্যে ভারতের একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি পুনর্বিবেচনা করার ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া আদানি গ্রুপে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে ফ্রান্সের তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান টোটাল এনার্জি।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানির জন্য ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খন্ডের গোড্ডায় দুই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়েছে আদানি গ্রুপ। এই চুক্তি বাতিলের জন্য গত সপ্তাহে একজন আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের হাইকোর্ট চুক্তিটি পুনর্মূল্যায়নের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিকে নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে তদন্ত শেষে এ ব্যাপারে আদালত আদেশ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে ২০১৭ সালে আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ। গত আগস্ট মাসে গণবিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তার সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে আমদানি করা কয়লার বেশি দাম দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। গত বছর উৎপাদনে যাওয়া ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎচাহিদার এক দশমাংশ পূরণ করে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
বিগত সরকারের আমলে যেসব বিদ্যুৎচুক্তি হয়েছে সেগুলো এখন পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করে দেওয়া একটি কমিটি। চুক্তিগুলো যথাযথভাবে হয়েছে কি না, চুক্তির ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে কি না, জাতীয় স্বার্থ বিনষ্ট হয়েছে কি না, এসব বিষয় যাচাই করে দেখছে কমিটি।
২০২২-২৩ অর্থবছরে আদানির উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১৪ টাকা ২ পয়সা দরে আমদানি করে বাংলাদেশ। ভারতের যেকোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে এটাই ছিল সর্বোচ্চ দাম। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিদ্যুতের গড় দাম ছিল ৮ টাকা ৭৭ পয়সা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে আদানির বিদ্যুতের দাম ১২ টাকায় নেমে এলেও তা ছিল ভারতের অন্যান্য বেসরকারি উত্পাদনকারীর তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশে খুচরা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৮ টাকা ৯৫ পয়সা। এই খাতে সরকারকে প্রতি বছর ৩২০ বিলিয়ন টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বলে জানান জ্বালানি উপদেষ্টা।তিনি বলেন, ‘দাম বেশি হওয়ায় সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। আমরা চাই বিদ্যুতের দাম, শুধু আদানি থেকেই নয়, গড় খুচরা দামের নিচে নামুক।’
জ্বালানি উপদেষ্টা জানান, বাংলাদেশ আদানির কাছ থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ অব্যাহত রাখবে। সম্প্রতি বকেয়া পরিশোধ বিলম্বিত হওয়ার কারণে আদানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেকে কমিয়ে দিয়েছে।
ফাওজুল কবির খান আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ক্ষমতা চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট, যদিও কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাস সংকট বা অন্যান্য কারণে অচল বা কম উৎপাদন করছে। যখন আদানি সরবরাহ অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছিল, তখন তেমন কিছুই ঘটেনি। আমরা কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদককে আমাদের ব্ল্যাকমেল করতে দেব না।’