যৌক্তিক সময় কখন সরকারই বলুক
সরকারের পারফরম্যান্স আশাব্যঞ্জক নয় ।। সংস্কারে দশটা কমিশনের দরকার ছিল না
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তার দলটি গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শরিক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের (চাকসু) জিএস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি ছিলেন মান্না। এক সময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারবিরোধী ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ছিলেন সামনের সারিতে। আলোচিত এই রাজনীতিবিদ সমসাময়িক নানা ইস্যুতে সম্প্রতি দৈনিক আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার মতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চলমান সংস্কার কাজ এবং নির্বাচনের বিষয়ে প্রত্যাশিত ‘যৌক্তিক সময়’ সম্পর্কে ব্যাখ্যা এই সরকারের পক্ষ থেকেই আসা উচিত। তার সঙ্গে কথা বলেছেন আমাদের সময়ের নিজস্ব প্রতিবেদক মুহম্মদ আকবর
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে দেশে নিত্যনতুন নানা পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে। এ অবস্থায় সংস্কার কার্যক্রম ও আগামী নির্বাচন সম্পর্কে কী ভাবছেন? শুরুতেই এই প্রশ্ন করা হলে জবাবে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘নির্বাচনের যৌক্তিক সময় কোনটা তা সরকারের পক্ষ থেকেই বলুক। এসব আমাদের বলে দেওয়ার ব্যাপার না। তারা কী করতে চায়, করে দেখাক। তারা দশটা কমিশন করেছে। আমার মনে হয় এত কমিশনের দরকার ছিল না।’ তিনি বলেন, ভোট করবার জন্য প্রয়োজন এমন পুলিশ বাহিনী, যারা প্রো-পিপল, প্রো-ইলেকশন, প্রো-ডেমোক্রেসি (জনগণ,
নির্বাচন ও গণতন্ত্রের পক্ষে) থাকবে। (পুলিশকে কেন্দ্র করে) এই তিনটা জিনিস করতে কত সময় লাগবে, তা সরকারই ভালো বলতে পারবে। পুলিশ এখন পেশাদারির জায়গায় ২০ শতাংশও ঠিক হয়নি। তাদেরকে শুধু শতভাগ সক্রিয় করাই যথেষ্ট নয়, নির্বাচনের প্রতিও প্রো-অ্যাকটিভ করে তুলতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে মান্না বলেন, ‘এগুলো (সংস্কার) করতে কত দিন লাগবে? সরকারের এতদিনের পারফরম্যান্স তো আমার কাছে আশাব্যঞ্জক মনে হয়নি। এখন তাদের যত দিন লাগবে, তত দিন বলুক। তাদের পক্ষ থেকে বিশেষ করে সেনাবাহিনী প্রধান বলেছেন নির্বাচন দেড় বছরের মধ্যে সম্ভব। আইন উপদেষ্টা বলেছেনÑ ’২৫ সালের মধ্যে করা সম্ভব, নৌ-উপদেষ্টা বলেছেনÑ ’২৬ সালের মাঝামাঝি। তারাই তো এসব বলবেন। কিন্তু তারা যদি বলেন পাঁচ বছর লাগবে। তা হলে তো হবে না!’
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
আগামী নির্বাচনের প্রত্যাশিত পরিবেশ সম্পর্কে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি বলেন, ‘নির্বাচনের পরিবেশ বলতে আমরা সব সময় যা বলে আসছি, অর্থাৎ সরকার যেন দমন-পীড়ন না করে। গত তিনটা নির্বাচন যে হলোÑ এসবে কী নির্বাচনের পরিবেশ ছিল? সরকারি দল যে রকম চেয়েছে, সে রকম নির্বাচন হয়েছে। বিরোধী কাউকে ক্যাম্পেইন করতে দেয়নি, বেধড়ক পিঠিয়েছে, নির্যাতন করেছে। তারপর ভোটের দিনে কী হয়েছে তা তো সবার জানাই। আমরা নির্বাচনের পরিবেশ বলতে বুঝিয়েছিÑ নির্বাচনী খেলার মাঠটা যেন সমান থাকে। সবার সমান অধিকার থাকে। সবাই সমানভাবে প্রচার করতে পারে। কারও পক্ষে গিয়ে যেন সরকারি নিপীড়ন, নির্যাতন না হয়।’
আগামী নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই বলে মনে করেন মাহমুদুর রহমান মান্না। তবে সরকারের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না যে, ড. মুহম্মদ ইউনূস ধান্দাবাজি করে ক্ষমতায় থাকতে চান। তাদের অভিজ্ঞতা নাই। অভিজ্ঞতা না থাকলে যোগ্যতাও হয় না। এ জন্য যে কাজ অন্যরা তিন মাসে করতে পারে, সেখানে তাদের ৬ মাস লাগতে পারে। কিছু কাজ যা ঠিকমতো হওয়া দরকার, তা উল্টা করে ফেলতে পারেন। তাদের ভুল কাজে এমন পরিবেশ হতে পারে, যাতে নির্বাচন বিলম্বিত করে। দেশের সিকিউরিটি বিঘ্নিত হতে পারে।’
সম্প্রতি ইসকন নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে। একটি অনুষ্ঠানে আপনি বলেছেন, ইসকনের নিবন্ধনই নেই, তা হলে নিষিদ্ধের প্রশ্ন আসছে কেন? ইসকন নিয়ে দেশে পক্ষে-বিপক্ষে শক্তি দাঁড়িয়ে গেছে। আন্তর্জাতিকভাবেও নানা প্রশ্ন উঠছে। ইসকন ও চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের ইস্যুটি কতদূর যাবে বলে আপনার ধারণা? জবাবে মান্না বলেন, ‘ইসকনকে নিয়ে তো প্রশ্ন উঠছে না। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে ইসকন বিবৃতি দিয়ে বলেছে যে, এই চিন্ময় তাদের সংগঠনের কেউ নন। তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। উনি (চিন্ময়) নিজেও ইসকনের বলে দাবি করছেন না। উনি কেন গ্রেপ্তার হলেনÑ এটাও ভালো করে বুঝতে পারিনি।’
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে ইসকনের পক্ষ থেকে তো আন্দোলন হচ্ছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেনÑ এ প্রশ্নের জবাবে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘ইসকনের পক্ষ থেকে নয়। সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট নামের একটা সংগঠন সেটা করছে। উনি (চিন্ময় কৃষ্ণ দাস) রংপুরে একটা বড় প্রোগ্রাম করলেন। ফেরার পথে ঢাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। রংপুরে এমন ভায়োলেন্ট ব্যাপারও ছিল না। ওনারা রংপুরে যে দাবি দিয়েছিলেন সেগুলোর জন্য গ্রেপ্তার কিনা। এর আগে (লেখক ও চিন্তক) ফরহাদ মজহার তার সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। সেই কথাবার্তার রেজাল্ট কী হলো। ফরহাদ মজহার তার গ্রেপ্তারের বিরোধিতাও করেছেন। এ নিয়ে আমি কনফিউজড। তবে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের লোকজন যে রকম অংশ নিয়েছে, ভায়োলেন্স করেছে, তাতে বোঝা যায় এটার পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে।’
মান্না বলেন, ভারতের মিডিয়া বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সিকিউরিটি নিয়ে কথা বলেছে। বাস্তবে তো এ রকম ইস্যু নাই। ভারতের এটা বোঝা দরকারÑ এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানরা তো বাংলাদেশের মানুষ। এটা আমাদের বিষয়। এটা নিয়ে তারা এত কথা বলছেন কেন। ওদের ওখানে মুসলমানদের ওপর এত অত্যাচার হয়, আমরা তো রিয়েক্ট করি না। আমরা তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাই বলে সবকিছুতে এত রিয়েক্ট করি না। কিন্তু তারা নেগেটিভ রিয়েক্ট করে।’ এই ইস্যুতে আন্দোলন বা বাগবিতণ্ডার পরিণতি কী হবে? জবাবে তিনি বলেন, ‘পরিণতি আর কী হবে। দ্য মাস্ট কাম গুড সেন্স। কারণ আমরা এখানে মাইনোরিটির অধিকার হরণ করি না, নিগ্রহ করি না। বরঞ্চ হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান একসঙ্গে বাস করি। ওরা যদি জোর করে কোনো সমস্যা চাপিয়ে দেয়...। এখন কী পৃথিবীতে এমন অবস্থা আছে? দেখতে হবে।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সামান্য দাবিতেও পথে নেমে আসছে মানুষ। এর কারণ জানতে চাইলে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘স্বাধীনতা পেয়েছে। মানুষ জানে যে এখন দাবি জানালে গ্রেপ্তার হবে না, জীবনটা যাবে না। কোনো অত্যাচার হবে না।’ চলমান অস্থিরতা, রাজপথে নৈরাজ্য, মারামারি, মামলা-হামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, এসব তো ঠিক দাবি-দাওয়া না। ঢাকা কলেজ সিটি কলেজর মধ্যে মারামারি এগুলো তো বাসে ওঠা নিয়ে, টেক্সটাইলে যে মারামারি হলো তা নাশতা খাওয়া নিয়েÑ কে কোথায় বসবে। আমি যা শুনলাম আর কী। পুরান ঢাকায় যেটা হয়েছে সেটা হয়তো এভয়েড করা যেত। এটা এতদূর না গেলেও হতো। এক ধরনের অধৈর্য আছে আমাদের। আছে নাÑ বেশি স্বাধীনতা হলে বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। চট্টগ্রামের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এ ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই।’
একটি কথা জোর দিয়েই উঠছে যে, এ সরকার সবকিছু সামাল দিতে পারছে না। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মান্না বলেন, ‘সরকার সামাল দিতে পারছে না...। হয়তো পারছে না। আমি এটাকে বড় করে দেখছি না। আমি বরং চট্টগ্রামের মানুষের ধৈর্য দেখে অবাক হচ্ছি। তারা তো নিজেরা নিজেদের সামাল দিতে পেরেছে। তাদের ইমোশন কন্ট্রোল না করতে পারলে চট্টগ্রামে রায়ট হতে পারত। কিচ্ছু হয়নি। অথচ এই রকম প্রকাশ্যে পিটিয়ে, ছুরি দিয়ে হত্যা করা হলো। এর বিপরীতে কোনো জেহাদি গ্রুপ হিন্দুদের মারতে চলে আসেনি। এটাই আমাদের সেফ করে দিয়েছে। মানুষের সরকারের প্রতি আস্থা আছে বলেই এটা এতদূর যায়নি।’
সরকারের মধ্যে বা সরকারের শুভানুধ্যায়ীদের কেউ কেউ বলছেন, এ দেশে হিন্দুত্ববাদের বীজ উঠিয়ে দিতে হবে। এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?- এর জবাবে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি বলেন, “আমি এ রকম কিছু দেখছি না। এখনও এটাকে এভাবে নেওয়ার দরকার মনে করি না। ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে আমি শুনেছি। এটা অ্যালার্মিং। এটা খেয়াল রাখা দরকার। কিন্তু হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়নি। হিন্দু ধর্মের মানুষ যে পাঁচ দফা দিয়েছে, তাতে তো এ রকম কিছু নেই। এখন হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করতে দেওয়া হবে না বা হটিয়ে দেওয়া হবেÑ এমন কথা যারা বলেছেন তা সম্ভবত তাদের ব্যক্তিগত, সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কথা এটা হতে পারে না। এটা নিয়ে বলতে হলে আমার জেনে বলতে হবে।’’