১৭ বছরের সিন্ডিকেট ১৭ দিনে ভাঙা অসম্ভব
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন এ এফ হাসান আরিফ। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি। সম্প্রতি নিজ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সমসাময়িক ইস্যুতে আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা বলেছেন সরকারের এ উপদেষ্টা। চলমান সংস্কারকাজ এবং আগামীর নির্বাচন নিয়ে প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তার মতে, সংস্কারকাজ এককালীন কোনো বিষয় নয়। দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৭ বছরের সিন্ডিকেট ১৭ দিনে ভাঙা সম্ভব নয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার তাওহীদুল ইসলাম
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। সংস্কারকাজ শেষ হবে কবে- এমন প্রশ্নের জবাবে বেসামরিক বিমান পরিবহন, পর্যটন ও ভূমি উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, সংস্কার কোনো ওয়ান-অফ ইভেন্ট (এককালীন বিষয়) নয়। ধরুন কোনো ঘটনার তদন্ত হয়েছে; কিন্তু ব্যবস্থা
নেওয়া হয়নি। অর্থাৎ, সমস্যা চিহ্নিত হলেও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এখন সেগুলো দেখার নামই সংস্কার। দুর্নীতির পথগুলো বন্ধ করাই সংস্কার। এটি সব মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সমস্যাগুলোর উৎস বন্ধ করাই সংস্কার। কেন সমস্যাটি হলো তা খতিয়ে দেখে দূর করা। সিস্টেম ডেভেলপ করাই মূল সংস্কার। সিস্টেমের কারণে কিংবা সক্ষমতার অভাবে যদি অনিয়ম হয়, সে জায়গাগুলোয় হাত দিতে হবে।
এ এফ হাসান আরিফ বলেন, সিস্টেম কিনতে পাওয়া যায় না। এটি ডেভেলপ করতে হবে। প্রবলেম স্টাডি করতে হয়। এ জন্য ডেটা লাগবে। আমি তো প্রত্যেকটি সংস্থার কাছে প্রশ্ন করিÑ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট আছে কিনা। ধরুন বিমানের চোরাচালানের কথা। কোন ফ্লাইটে সত্যিকারের যাত্রী আসেন, এর মধ্যে কারা চোরাকারবারিতে জড়িত, তাদের আগের কোনো রেকর্ড আছে কি নাÑ এমন ডেটা দরকার। বাস্তবতা হচ্ছে তথ্যের বিরাট অভাব। প্রতিটি বিষয় এভাবে দেখে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
নির্বাচনের আগে সংস্কারকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব কিনাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে ভূমি উপদেষ্টা বলেন, শেরে বাংলা ফজলুল হকের আমলে ঋণ সালিশ বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। তখন সমাজে ক্ষুদ্রঋণ ছিল না। ব্যাংক ঋণ দিত না, দিত মহাজন। তাদের হাত থেকে রক্ষা করতে বোর্ড করেছিলেন শেরে বাংলা। এটাকেই বলে সংস্কার। এখনও সংস্কার চলছে। ড. ইউনুস ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে এলেন। অন্যরা এখন দিচ্ছেন। আমি বলি, সংস্কার কোনো ওয়ান অব ইভেন্ট নয়। এটি প্রসেস। চলমান। এখন খতিয়ান নিয়ে তহশিলদারকে ঘুষ দিতে হবে না। জরিপের জন্য আমিন এলে আগে কী অবস্থা হতো। এখন ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা। ভূমির রেজিস্ট্রেশন নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে হওয়ার কথা। এ রকম একটা সুপারিশ ছিল। আরও বেটার সিস্টেম করাই সংস্কার। ধরুন বিমানের চোরাই স্বর্ণ এসেছে। তা প্রযুক্তির কোনো মাধ্যমে বের করতে পারলে সেটাই ভালো। সুতরাং, সংস্কার কখনও শেষ হয় না।
নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে মানুষের আগ্রহ অনেক। এ বিষয়ে হাসান আরিফ বলেন, এটি আসলে আমি বলতে পারব না। নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে। তাদেরকেই জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে। স্থানীয় সরকার নির্দলীয় করার দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি নিয়ে সংস্কার কমিশন কাজ করছে। সবার মতামত নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন আইনও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। কোনটি ভালো হবে তাই করবে সরকার। বিশেষ করে ভোটার তথা জনগণের মতামতকেই প্রাধান্য দেওয়া দরকার। মাঠপর্যায়ে যিনি ভোট দেবেন, তার মতটাই জরুরি।
দ্রুব্যমূল্য এখনও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি বর্তমান অন্তবর্তী সরকার। এ বিষয়ে বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা বলেন, ১৭ বছরের সিন্ডিকেট ১৭ দিনে ভাঙা সম্ভব নয়। ধরুন বগুড়ার মোকাম থেকে হাতবদলের কারণে ঢাকায় দাম বেড়ে যায়। এখানে মধ্যস্বত্বভোগী আছে। উৎপাদকের কাছ থেকে পাইকারি বাজার পর্যন্ত পণ্য আসার ক্ষেত্রে কী কী বাধা, তা দূর করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বা ছোবল দূর করা জরুরি। এ জন্য কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন, টিসিবি থেকে শুরু করে ব্যক্তি, সংস্থা বা সংগঠনের দায়িত্ব আছে। আমি মনে করি, সিন্ডিকেট ভাঙা কঠিন নয়। সমন্বিত ব্যবস্থা লাগবে। এটি কঠিন নয়।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
নতুন দায়িত্ব পাওয়া মন্ত্রণালয়ের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা হাসান আরিফ বলেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এটাকে আরও গতিশীল করা। এটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের আকাশসীমায় আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল করে। এ মুহূর্তে আরেকটি চালেঞ্জ থার্ড টার্মিনাল। আগামী বছরের মধ্যে ব্যবহার যোগ্য হওয়ার কথা। অনেক কিছুর কাজ চলমান। এরপর যাত্রীরা ব্যবহার করতে পারবেন। পরের চ্যালেঞ্জ এটির ব্যবস্থাপনা। বিমান ওঠানামার জন্য গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং। অন্যান্য দেশের বিমানবন্দরের মতো যেন সুবিধা থাকে। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জাপান, মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরের মতো বা তারচেয়ে উন্নত করার চেষ্টা চলছে। অন্য বিমানবন্দরের মতো যেন ভালো অভিজ্ঞতা হয় ,সে চেষ্টা করছে সরকার।
বিমানের ইমেজ সংকট কাটানো ও সক্ষমতার ঘাটতি প্রসঙ্গে বিমান চলাচল ও পর্যটন উপদেষ্টা বলেন, বিগত দিনের কার্যক্রমের কারণে বিমানের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং তথা যাত্রী ও কার্গো বহন থেকে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে। মান উন্নত করে দায় ঘুচানোর কাজটি বিমানকেই করতে হবে। যেহেতু তিনটি টার্মিনাল হচ্ছে। ফ্যাসিলিটিজ বাড়ছে। তাই আগের ১ ও ২ নম্বর টার্মিনালের সেবার মতো ভাবলে বা ওই আঙ্গিকে বিচার করলে হবে না। আশা করি, আগের চেয়ে অনেক বেশি সার্ভিস দিতে পারবে। বিমান সক্ষম হয়ে দক্ষ হয়ে ওঠবে।
শাহজালাল বিমানবন্দরে রানওয়ের সমস্যা প্রসঙ্গে হাসান আরিফ বলেন, থার্ড টার্মিনালে প্রথমদিকেই ঝাঁকে ঝাঁকে যাত্রী আসবে না। এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ১০ বছরও লাগতে পারে। তাই আমরা আশাবাদি। এভিয়েশনের হাবের উপযোগী করে পদক্ষেপ নেবে সরকার। বিগত ১৬-১৭ বছরের চর্চায় দেখেছি, বিপুল বিনিয়োগ। অপচয়ের খবর আসছে। আমরা বিনিয়োগের রিটার্ন নিয়ে ভাবছি। যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করতে হবে।
বিমানকে লাভজনক করার প্রসঙ্গ তুললে বিমান পরিবহন উপদেষ্টা বলেন, একদিনে তো লাভজনক করা যাবে না। কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিনেও সম্ভব নয়। আগে যেসব কারণে বিমানকে লাভজনক করা যায়নি, সেসব কারণ খুঁজে বের করতে হবে। দূর করতে হবে দুর্নীতি ও অনিয়ম। বিমানের টিকিট কারসাজির বিষয়গুলোও আমরা দেখব। বিগত সময়ে সমস্যা চিহ্নিত হলেও ব্যবস্থা হয়নি। তদন্ত হলেও ব্যবস্থা নেয়নি তখন। প্রয়োজনে নতুন তদন্ত হবে। পাইলট নিয়োগে অনিয়ম বা স্বজনপ্রীতির খবর পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যেখানে যে ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়েছে, তদন্তে কোনো কিছুই বাদ যাবে না। খবর পেলে প্রয়োজনে টেবিলে টেবিলে ঘুরে দুর্নীতি চিহ্নিত করার ব্যাপারে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এ উপদেষ্টা। কোনোভাবে তথ্য পেলে সংশ্লিষ্ট ফাইল নিজে তলব করার কথাও জানান তিনি।