উত্তর প্রদেশের মসজিদ নিয়ে কেন এত উত্তেজনা?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৮:৫৩
শেয়ার :
উত্তর প্রদেশের মসজিদ নিয়ে কেন এত উত্তেজনা?

বিতর্কের কেন্দ্র বিন্দুতে উঠে এসেছে ভারতের উত্তর প্রদেশের সম্ভলের শাহী জামা মসজিদ, রবিবার সকালে যা কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল। শতাব্দী প্রাচীন শাহী জামা মসজিদে দ্বিতীয় দিনের সমীক্ষাকে ঘিরে এখন পর্যন্ত চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তারা সবাই মুসলিম।  এই মসজিদের ইতিহাস ও বিতর্ক নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

মোরাদাবাদ রেঞ্জের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল মুনিরাজ জি সোমবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘গতরাতে আমরা তিনজন ব্যক্তির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করলেও, আজ মোরাদাবাদে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এই নিয়ে এখনও পর্যন্ত মোট চার জনের মৃত্যু হয়েছে।’

অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন চেষ্টা করছে।

যে বিষষ নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত তা হল, হিন্দত্ববাদী সংগঠনের দাবি যে ওই মসজিদে একসময় মন্দির ছিল এবং ওই ভবনের স্থাপত্যে তার প্রমাণও রয়েছে। এই দাবিকে কেন্দ্র করে কয়েকজন আবেদনকারীর হয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেন আইনজীবী বিষ্ণু শঙ্কর জৈন। অন্যদিকে, মুসলিম পক্ষ এই দাবি খারিজ করেছে। তাদের বক্তব্য শতাব্দী প্রাচীন এই মসজিদে তারা বংশপরম্পরায় নামাজ পড়ে এসেছেন। এই ভবনে কখনো মন্দির ছিল না।

এই বিতর্কের জেরে সমীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়। হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল কি না, সেটা যাচাই করে দেখার জন্যই দ্বিতীয় দফায় অ্যাডভোকেট কমিশনারের নেতৃত্বে একটি দল সেখানে যায়। তখন পুলিশ ও বিক্ষুদ্ধদের মধ্যে সংঘর্ষে রোববার তিনজনের মৃত্যু হয়েছে এবং বহু পুলিশকর্মীও জখম হন।

কৈলাদেবী মন্দিরের মহন্ত ঋষিরাজ গিরি মহারাজ দাবি করেছেন, সম্ভলের শতাব্দী প্রাচীন ওই মসজিদে একসময় মন্দির ছিল। তার দাবি, ওই ভবনে হরিহর মন্দির ছিল।

গত ১৯ নভেম্বর মহন্ত ঋষিরাজ গিরি মহারাজের মতো একাধিক আবেদনকারীদের হয়ে জামা মসজিদে সমীক্ষার দাবি জানিয়ে সম্ভলের সিভিল জজ সিনিয়র ডিভিশনের আদালতে মামলা দায়ের করেন আইনজীবী বিষ্ণু শঙ্কর জৈন। সেদিন শুনানির সময় আবেদনকারী ছাড়া অপর পক্ষের আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।

প্রসঙ্গত, বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ মামলাতেও হিন্দুপক্ষের হয়ে মামলা লড়ছেন বিষ্ণুশঙ্কর জৈন। 

মসজিদ কমিটি জানিয়েছে, এই মামলার বিষয়ে তাদের জানানো হয়নি। একইসঙ্গে, মসজিদের জায়গায় এক সময় মন্দির ছিল এরকম দাবিকে ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেছেন তারা। তাদের পাল্টা অভিযোগ, আদালতে মামলা দায়ের করে নতুনভাবে রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি এবং শিরোনাম দখলের চেষ্টা চলছে।

এই মামলায় সাত দিনের মধ্যে সমীক্ষার নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। একইসঙ্গে জরিপের দায়িত্বে থাকা দলকে ভিডিও এবং ফটোগ্রাফি-সহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। এই মামলায় রমেশ সিং রাঘবকে অ্যাডভোকেট কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করেছে আদালত।

মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সমীক্ষার বিষয়ে আদালতের নির্দেশের কথা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয়।

মসজিদ কমিটির সঙ্গে যুক্ত আইনজীবী জাফর আলী বিবিসিকে বলেছিলেন, “আদালত প্রাঙ্গণে আমরা গেরুয়া পোশাক পরা বেশ কয়েকজনকে চলাফেরা করতে দেখে আমাদের সন্দেহ হয় যে কিছু একটা ঘটছে। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সম্ভল পুলিশের তরফে আমাদের বলা হয় যে আমাদের মসজিদ চত্বরে পৌঁছতে হবে কারণ আদালতের নির্দেশে সমীক্ষা চলবে।”

রমেশ সিং রাঘবের নেতৃত্বে ১৯ নভেম্বর বিকেলে প্রথমবার মসজিদে গিয়েছিল জরিপের দায়িত্বে থাকা দল। সেই সময় সম্ভলের পুলিশ সুপার কৃষ্ণ কুমার জানিয়েছিলেন, মোটের উপর শান্তিপূর্ণ ছিল সেদিনের সমীক্ষা।

তিনি বলেছিলেন, ‘আদালতের নির্দেশে পুলিশ বাহিনীর উপস্থিতিতে জরিপ সম্পন্ন হয়। সেই সময় কোনও বিশৃঙ্খলা হয়নি। নিরাপত্তার দিক থেকে মসজিদ চত্বরে পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।’

সম্ভলের জেলাশাসক রাজেন্দ্র পেনসিয়া জানিয়েছেন, সেইবার রাত হয়ে যাওয়ায় সমীক্ষা শেষ করা যায়নি। তাই রোববার সমীক্ষার জন্য আবার গিয়েছিল ওই দল।

জেলা শাসক জানিয়েছেন রোববার, জরিপ ভালোই চলছিল, কিন্তু মসজিদের বাইরে পৌঁছে একদল বিক্ষুব্ধ মানুষ হঠাৎই পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়তে শুরু করে। পরে পরিস্থিতি আরও জটিল হয় এবং সহিংসতার ঘটনায় পরিণত হয়।

শাহী জামা মসজিদ, যা সম্ভলের স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জামা মসজিদ নামেই পরিচিত, একটা শতাব্দী প্রাচীন মসজিদ। সম্ভলের ঐতিহাসিক এই মসজিদ ঠিক কবে নির্মাণ করা হয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। হিন্দু পক্ষ আদালতে দাবি করেছে যে এটি মুঘল শাসক বাবরের নির্দেশে হিন্দু মন্দিরের জায়গায় এই মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল।

সম্ভলের ইতিহাস ‘তারিখ-এ সম্ভল’ বইয়ের লেখক মাওলানা মোঈদ। তিনি বলেন, “বাবর এই মসজিদ মেরামত করিয়েছিলেন। কাজেই এই তথ্য সঠিক নয় যে এই মসজিদ বাবর নির্মাণ করেছিলেন।”

তার কথায়, ‘এটা ঐতিহাসিক সত্য যে ১৫২৬ সালে লোধী শাসকদের পরাজিত করে বাবর সম্ভল সফর করেছিলেন। কিন্তু জামা মসজিদ তিনি নির্মাণ করেননি।’

মাওলানা মঈদের মতে, সম্ভবত তুঘলক আমলে তৈরি হয়েছিল এই মসজিদ। কারণ তার পর্যবেক্ষণ বলছে মসজিদের নির্মাণশৈলী মুঘল আমলের সঙ্গে মেলে না।

১৯২০ সালে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার বা পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে এই ভবনকে সুরক্ষিত ভবন হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এটা জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন ভবনও বটে। আপাতত ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে এই মসজিদের জরিপ চলছে।

পিটিশনে কী বলা হয়েছে

আবেদনকারী মহন্ত ঋষিরাজ গিরির বক্তব্য, “আমরা বিশ্বাস করি এই মসজিদ যেখানে রয়েছে সেখানে হরিহর মন্দির ছিল। এর কাঠামোও মন্দিরের মতো। আমরা আমাদের মন্দির ফিরে পেতে চাই এবং সেই জন্য আইনি লড়াই করছি।”

হিন্দু পক্ষের পক্ষে দায়ের করা আবেদনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, সংস্কৃতি মন্ত্রক, ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ সর্বেক্ষণ, প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের মেরাঠ জোনের সুপারিনটেনডেন্ট, সম্ভলের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং মসজিদের পরিচালনা কমিটিকে বাদী করা হয়েছে।

পিটিশনে বলা হয়েছে জামা মসজিদের ভবন আসলে শতাব্দী প্রাচীন হরিহর মন্দির, যা ভগবান কল্কিকে উৎসর্গ করা হয়েছে।

আবেদনকারীরা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে ভগবান কল্কি সম্ভলে অবতীর্ণ হবেন বলেও বিশ্বাস করা হয়। আবেদনকারীদের বক্তব্য, তারা হিন্দু, মূর্তি পূজায় বিশ্বাসী। ওই ভবনে ভগবান শিব ও বিষ্ণুর উপাসক এবং কল্কি অবতারের পুজো করা তাদের অধিকার। এই মসজিদ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক এবং সবাই যাতে অবাধে যাতায়াত করতে পারে সেই আর্জি জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন তারা (আবেদনকারীরা)। আদালত এই আবেদন গ্রহণ করে ওইদিনই জরিপের জন্য নোটিশ জারি করে।

এর আগেও এই মসজিদকে কেন্দ্র করে বিতর্ক হয়েছে। ১৯৭৬ সালে মসজিদের ইমামকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় সেখানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৮০ সালে পার্শ্ববর্তী শহর মোরাদাবাদে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে তার উত্তাপ সম্ভলেও পৌঁছায়। জামা মসজিদের ভবনে একসময় হিন্দু মন্দির ছিল এই দাবি আগেও জানিয়ে এসেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। শিবরাত্রির সময় ওই প্রাঙ্গণে নির্মিত কূপের পুজো দেওয়ার চেষ্টা হয় বলেও মুসলিম সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

তবে এই প্রথম আদালতে এই মসজিদকে নিয়ে কোনও মামলা দায়ের করা হয়েছে। মুসলিম পক্ষের আইনজীবী মাসুদ আহমেদ বলেছেন, ‘মামলা দায়ের করে এই মসজিদকে বিতর্কিত বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এর আগে এই নিয়ে কোনও মামলা হয়নি।’

মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে জাফর আলীও একই কথা বলেছেন। তার মতে, ‘এই মসজিদ নিয়ে কিন্তু কোনও আইনি বিবাদ নেই। যদিও হিন্দু সংগঠনগুলো মাঝে সাঝেই এই মসজিদ নিয়ে বিবাদ সৃষ্টি করে।’

অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ বলছেন, ‘বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, মঙ্গলবার বিকেলে আদালতে এই মামলা দায়ের করা হলো, বিরোধীদের বক্তব্য না শুনেই জরিপের নির্দেশ দেওয়া হলো এবং একই দিন সন্ধ্যায় জরিপও করা হলো। অথচ ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত সময় রয়েছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার। এতেই বোঝা যাচ্ছে গোটা পরিকল্পনার আড়ালে একটা বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে। তবে আমরা আইনি লড়াই লড়তে প্রস্তুত। অপরপক্ষের দাবি আদালতে টিকবে না।’