গানে সুরে বাঁশির জাদুতে নেচে ওঠে প্রাণ
বারী সিদ্দিকীর আজ সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী
প্রখ্যাত বংশীবাদক, কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী বারী সিদ্দিকী। আজ এই গুণীশিল্পীর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৭ সালের ২৪ নভেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। বাঁশির সুর যেমন হৃদয় কেড়েছে সবার, তার গানেও নেচে ওঠে প্রাণ। তিনি ছিলেন অনন্যশিল্পী। উপহার দিয়েছেন ‘শুয়া চান পাখি’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘পুবালি বাতাসে’, ‘আমি একটা জিন্দা লাশ’, ‘রজনী’, ‘সাড়ে তিন হাত কবর’, ‘ওলো ভাবিজান নাউ বাওয়া’, ‘মানুষ ধরো মানুষ ভজো’সহ অসংখ্য গান। যে গানগুলো একটানা শুনলেও শ্রোতাদের শোনার আগ্রহ শেষ হয় না।
বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন বড় ভাইয়ের বাঁশিতে সুযোগ পেলেই ফুঁ দিতেন। বাঁশি তাকে গভীরভাবে টানত। বাঁশি শেখার প্রতি অন্য রকম আগ্রহের সৃষ্টি করত। মায়ের কাছ থেকে জীবনে তিনি প্রথম যে গানটির সুর বাঁশিতে তুলে নিয়েছিলেন, সেই সুরটিই পরে হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছিলেন। সেটি ছিল শ্যাম বিচ্ছেদের একটি সুর। মুখটা ছিল এ রকমÑ ‘আষ্ট আঙুল বাঁশের বাঁশি/মধ্যে মধ্যে ছ্যাদা/নাম ধরিয়া ডাকে বাঁশি/কলঙ্কিনী রাধা।’ যার কথা বলছি সেই মানুষটি বারী সিদ্দিকী যখন হাইস্কুলে পড়তেন, তখন থেকেই নেত্রকোনা শিল্পকলা একাডেমিতে সংগীত শেখা শুরু করেন। তার সংগীতের ওস্তাদ ছিলেন গোপাল দত্ত। ওই সময় বড় দুই ভাই এবং রফিক মাহমুদ, বিপুল চৌধুরী, দুলাল দত্তনবীশ ও হযরত আলীর কাছ থেকেও গানে সহযোগিতা পেয়েছেন। ছোটবেলায় মূলত সংগীতশিল্পী হওয়ারই স্বপ্ন ছিল বারী সিদ্দিকীর।
১৯৮০ সালের দিকে ঢাকায় শুদ্ধ সংগীত প্রসারে একটি অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় ওস্তাদ আমিনুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বিমানের পাইলট ছিলেন। ভারতবর্ষের বিখ্যাত বংশীবাদক ওস্তাদ পান্না লাল ঘোষের শিষ্য ছিলেন। সেই আমিনুর রহমানের বাড়িতে থেকেই বাঁশিতে তালিম নিতে থাকেন দিনের পর দিন। সেখান থেকেই তিনি ওস্তাদ তাগাল ব্রাদার্স, প্লতি দেবেন্দ মুৎসুদ্দী ও ওস্তাদ আয়েফ আলী খান মিনকারীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। ১৯৮০ সালে পেশাগতভাবে বাঁশি বাজানো শুরু করেন তিনি। ১৯৮৬ সালে বিটিভিতে ‘সৃজন’ অনুষ্ঠানে প্রথম বাঁশি বাজান। কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন।
আরও পড়ুন:
ওটিটি প্ল্যাটফরম আমার জন্য বেশ লাকি
এক সময় তিনি শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে বাংলাদেশ রেডিও, টেলিভিশনসহ সম্মিলিত একটি যন্ত্রসংগীত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এর পর পরই তিনি দক্ষিণ এশীয় সার্ক ফেস্টিভ্যালে যান বাঁশি বাজাতে।
হুমায়ূন আহমেদের এক জš§দিনের অনুষ্ঠানে তার বাসায় যান বাঁশি বাজাতে। সেখানে বাঁশি বাজানোর পাশাপাশি গানও করেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদ তাকে আরও গান গাইতে বলেন অনুষ্ঠানে। গান শুনে মুগ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৯৫ সালে বিটিভির ‘রং-এর বারৈ’ অনুষ্ঠানে প্রথম গান করেন বারী সিদ্দিকী। এর পর পরই হুমায়ূন আহমেদ তাকে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে গান গাইতে বলেন। পাল্টে গেল তার সংগীতজীবন। একে একে চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেন তিনি। আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর পরই বাজারে তার দুটি একক অ্যালবাম আসে। একটি ‘দুঃখ রইলো মনে’ এবং অন্যটি ‘অপরাধী হইলেও আমি তোর’। দুটি অ্যালবামই লুফে নেন শ্রোতারা। বারী সিদ্দিকীর প্রকাশিত অন্য অ্যালবামগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সরলা’, ‘ভাবের দেশে চলো’, ‘সাদা রুমাল’, ‘মাটির মালিকানা’, ‘মাটির দেহ’, ‘মনে বড় জ্বালা’, ‘প্রেমের উৎসব’, ‘ভালোবাসার বসতবাড়ি’, ‘নিলুয়া বাতাস’ ও ‘দুঃখ দিলে দুঃখ পাবি’।
আরও পড়ুন:
ফের জুটি হলেন মম-শ্যামল
উকিল মুন্সীর লেখা গান জনগণের কাছাকাছি নিয়ে আসেন বারী সিদ্দিকী। তিনি নিজেকে একজন বংশীবাদক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। বংশীবাদক হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তিনি বাঁশি বাজিয়ে শ্রোতা-দর্শককে মুগ্ধ করেছেন। ১৯৯৯ সালে ফ্রান্সে ওয়ার্ল্ড ফ্লুট সম্মেলনে এ উপমহাদেশ থেকে তিনিই প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল অর্জন। গায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়ার আগের দুই দশক বারী সিদ্দিকীর ছিল বংশীবাদক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি।