প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে বিস্তর ফারাক, হতাশ বাংলাদেশ

আরিফুজ্জামান মামুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে বিস্তর ফারাক, হতাশ বাংলাদেশ

সংশয় প্রথম থেকেই ছিল। সেটিই সত্য হতে চলেছে। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে এবারের জলবায়ু সম্মেলনে মূল দাবি ছিল অর্থায়ন নিয়ে। যেসব ধনী দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে এতদিন পৃথিবীকে উত্তপ্ত করেছে, তাদের দিতে হবে ক্ষতিপূরণ। তবে জলবায়ু রাজনীতিতে দেশীয়-আঞ্চলিক, ব্যবসায়িক-ঐতিহাসিক স্বার্থ ও স্বার্থান্বেষী মহল যেমন জড়িত, তেমনি আছে দায়মুক্তির বাহানা। পরিবেশ নিয়ে সিদ্ধান্ত কার্যকরের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাব দেখা গেছে এবাবের জলবায়ু সম্মেলনে।

বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের শর্ত পূরণ না হলেও এবারের সম্মেলনে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর কাছে বছরে এক ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের দাবি ছিল স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশগুলোর। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর তরফে ২৫০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। গতকাল প্রকাশিত যৌথ পরিমাণগত লক্ষ্য বা এনসিকিউজিতে এই অর্থায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত স্বল্পোন্নত দেশগুলো এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ। তারা চায় উন্নত দেশগুলো যেন অন্তত ৫০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়। এমনকি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৪৫টি দেশের জন্য বিশেষ কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। গতকাল বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অর্থায়ন প্রশ্নে এখনো চলছে দরকষাকষি। শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে সেটিই এখন দেখার বিষয়।

এদিকে কপ-২৯ প্রেসিডেন্সির প্রকাশিত নতুন যৌথ পরিমাণগত লক্ষ্য (এনসিকিউজি) বিষয়ক সর্বশেষ খসড়া নিয়ে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। সম্মেলনের শেষ পর্বে পৌঁছে এটি প্রকাশিত হওয়ার পর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান একে ???‘খুবই হতাশাজনক’ একটি প্যাকেজ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এই খসড়া স্বল্পোন্নত দেশগুলো এবং ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর (সিডস) জরুরি চাহিদা পূরণে ব্যর্থ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বছরে ২৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দের প্রস্তাব আশ্চর্যজনকভাবে অপ্রতুল। এই বরাদ্দকে অনুদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি এবং এটি কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থার আওতায়ও নেই। এ ছাড়াও সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৪৫টি এলডিসির জন্য কোনো বিশেষ তহবিল বরাদ্দ করা হয়নি।

উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, কপ-২৯ মূলত জলবায়ু অর্থায়নকেন্দ্রিক হওয়া সত্ত্বেও এই প্রাপ্তি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অপ্রতুল। এই প্যাকেজটি এলডিসি এবং সিডসের মতো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাবও দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এলডিসি দেশগুলোকে এই প্যাকেজ প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যথাযথ সংশোধন ছাড়া এটি বাস্তবে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। সব অংশীদারকে আরও উচ্চাভিলাষী, ন্যায়সংগত এবং কার্যকর জলবায়ু অর্থায়ন কাঠামোর পক্ষে কথা বলার আহ্বান জানান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বলেন, যা বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দেয়।

অন্যদিকে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের চলমান এনসিকিউজি আলোচনায় অভিযোজন, ক্ষয় ও ক্ষতিপূরণসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে অনুদানভিত্তিক অর্থ বরাদ্দের আহ্বান জানান পরিবেশ, বন, জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এনসিকিউজি বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বক্তৃতাকালে উপদেষ্টা ন্যায্য, স্বচ্ছ এবং সমতাভিত্তিক জলবায়ু অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে বলেন, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাস্তব পরিস্থিতি প্রতিফলিত করে।

উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, উদ্দেশ্য নির্ধারণের প্রথম বিকল্পটি (অপশন-১) এখনও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) বাস্তবতা ও পরিস্থিতি বিবেচনায় আনেনি এবং এটি এখনও দুর্বল। অভিযোজন খাতে অন্তত ৫০ শতাংশ বরাদ্দের একটি পরিমাণগত ভাগ নিশ্চিত করতে হবে। নেগোশিয়েশনে তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল জি ৭৭, এলডিসি এবং ক্ষুদ্র দ্বীপ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে একটি শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক এনসিকিউজি কাঠামোর পক্ষে কথা বলেছে। তবে তিনি প্রস্তাবিত খসড়ার স্পষ্ট অনুদান উপাদানের অনুপস্থিতি এবং অনুদান অর্থায়নকে মোবিলাইজড ফাইন্যান্সের সঙ্গে সংযুক্তের বিষয়টি (যা অনুচ্ছেদ ২৩-এ উল্লেখ রয়েছে) নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দ্বিতীয় বিকল্পটি (অপশন-২) প্রত্যাখ্যান করেন, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর সব অর্থায়ন, বিনিয়োগ এবং এমনকি অভ্যন্তরীণ সম্পদ অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। এ ছাড়া, অনুচ্ছেদ ৩২ এবং ৩৩-এ উল্লেখিত কিছু অর্থায়ন চ্যানেলের বিষয়েও তিনি উদ্বেগ জানান। বলেন, এ ধরনের প্রস্তাব প্যারিস চুক্তির ন্যায্যতা, নীতিমালা, সমতা ও কমন বাট ডিফারেন্সিয়েটেফ রেস্পন্সিবিলিটি নীতির পরিপন্থি।

উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, এফডিসির আর্থিক বোঝা লাঘব করতে ঋণ মওকুফ অত্যন্ত জরুরি। অস্তিত্ব রক্ষার এই সংকটে এলডিসির আর কোনো ঋণ বহন করার সামর্থ্য নেই। পাশাপাশি তিনি ‘অস্বচ্ছ কার্বন বাজার’ বিষয়ক যে কোনো উল্লেখ অপসারণের আহ্বান জানান। কারণ এটি প্যারিস চুক্তির মূল চেতনাকে ক্ষণ্ন করে। তিনি বলেন, কপ-২৯ আলোচনা সমাপ্তির দিকে এগোতে থাকায় বাংলাদেশ এবং এলডিসি গোষ্ঠী সর্বাত্মকভাবে অংশগ্রহণ করে নিশ্চিত করতে চায় যে, এনসিকিউজির চূড়ান্ত কাঠামো ন্যায্যতা ও সমতা বজায় রাখবে এবং প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকবে।

এ ছাড়া জলবায়ু সংকটের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দের প্রস্তাবে সমর্থন জানাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। ২২ নভেম্বর বাকুতে কপ-২৯ এর চূড়ান্ত ফলাফলের বিষয়ে এলডিসি মন্ত্রী এবং ইইউ মন্ত্রীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এই আহ্বান জানানো হয়। বৈঠকে অবশিষ্ট সমস্যাগুলোর সমাধানে উভয়পক্ষের সহযোগিতার মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সমতাভিত্তিক চুক্তি অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। বাংলাদেশ প্রতিনিধি বৈঠকে বলেন, অনেক সমস্যা এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। তিনি উভয়পক্ষকে একযোগে কাজ করার মাধ্যমে কপ-২৯ এ একটি অর্থবহ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক চুক্তি নিশ্চিতের আহ্বান জানান। বৈঠকে এলডিসি মন্ত্রীরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আর্থিক ও কারিগরি সহায়তার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে তাদের মূল অবস্থান তুলে ধরেন। ইইউ মন্ত্রীরা এলডিসি দেশগুলোর উদ্বেগের বিষয়গুলো স্বীকার করেন এবং জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবিলা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন, নির্গমন হ্রাস এবং গ্লোবাল স্টকটেক প্রক্রিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কপ-২৯-এর চূড়ান্ত আলোচনায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার এ বৈঠক একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।