‘একটা বুলেটে আমার সুন্দর সংসার তছনছ হয়ে গেল’
আট বছরের শিশুটা প্রতিদিন রাতে তার বাবার জন্য কান্না করে। আমারে জিজ্ঞেস করে- ‘মা বাবা আইবো কখন, বাবা কই গেছে আমাগোরে রাইখা’। দেড় বছরের মেয়েটা আমার গলা জড়িয়ে ধরে শুধু বা-বা, বা-বা করতে থাকে। একটা বুলেটে আমার সাজানো সুখের সংসারটা তছনছ করে দিয়েছে। ছোট্ট শিশু দুটোর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে বাবার আদর, স্নেহ আর ভালোবাসা। অবুজ শিশু দুটো এখনও বুঝতে পারছে না ওদের বাবা এ পৃথিবীতে আর নেই। এখন আমি কী করব, কে দেখবে আমার এই নাবালক শিশুসন্তান দুটোকে? আমার স্বামীকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে, যারা আমার নাবালক সন্তান দুটির বাবা ডাক কেড়ে নিয়ে এতিম করে দিয়েছে, আমি তাদের বিচার চাই, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই’। গতকাল এ কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের ঝাটারা গ্রামের মো. মিলন হাওলাদারের স্ত্রী শাহনাজ বেগম ।
তিনি জানান, পরিবারের কেউ-ই এখন আর ভালো নেই। সেদিনের পর থেকে তাদের সব সুখ-আনন্দ-হাসি শেষ হয়ে গেছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে জীবন। কঠিন শোকে বাকরুদ্ধ পুরো পরিবার।
৩০ বছর বয়সী মিলন হাওলাদার পেশায় ছিলেন একজন মাছ ব্যবসায়ী। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে মিলন চতুর্থ। বোন মোর্শেদা বেগম, নাসরিন বেগম ও লাভলী বেগম বিবাহিত। বড় ভাই জাহাঙ্গীর হাওলাদার এলাকায় দিনমজুরের কাজ করেন এবং ছোট ভাই মুছা হাওলাদার একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। বাবা হোসেন হাওলাদার পঙ্গু আর মা মমতাজ বেগম বয়সের ভারে ন্যুব্জ। বর্তমানে মা-বাবা দুজনেই দুমকী উপজেলার কদমতলা আবাসন প্রকল্পের একটি ঘরে থাকেন। অভাবের সংসারে স্ত্রী-সন্তানদের মুখে দুই বেলা খাবার তুলে দিতে নিজ এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে ঢাকায় চলে যায় মিলন।
স্ত্রী শাহনাজ বেগমসহ ছেলে দ্বীন ইসলাম (৮) ও মেয়ে সুমাইয়া আক্তারকে নিয়ে নারায়ণঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। পছন্দসই ভালো কাজ না পেয়ে নিজেই মাছের ব্যবসা শুরু করেন মিলন। সকালে যাত্রাবাড়ী থেকে পাইকারি মাছ কিনে খুচরা বিক্রি করত বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায়। মাছের ব্যবসায় ভালোই চলছিল মিলনের সংসার। নিজের সংসারের খরচ মিটিয়ে বাড়িতে অসুস্থ মা-বাবার সংসারে অর্থের জোগান দিত মিলন।
কিন্তু একটি বুলেট এ পরিবারটির সুখের সাজানো সংসার তছনছ করে দিয়েছে। দিনটি ছিল রবিবার, ২১ জুলাই। পাইকারি মাছ কিনতে সকাল সকাল ঘর থেকে বের হয়ে যান মিলন। দেশের পরিস্থিতি উত্তাল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সারাদেশের ন্যায় নারায়ণগঞ্জ অগ্নিগর্ভ। দফায় দফায় চলছে সংঘর্ষ-সহিংসতা। কখনও ছাত্র-পুলিশ দ্বিমুখী, আবার কখনও ছাত্র-পুলিশ-ছাত্রলীগ ত্রিমুখী সংঘর্ষ। বেলা ১১টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়ে ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে আচমকা গুলিবিদ্ধ মিলন। তার বুকে গুলি ঢুকে পেছন থেকে বের হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। স্থানীয় লোকজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মিলনকে মৃত ঘোষণা করেন।
ষাটোর্ধ্ব মিলনের পঙ্গু বাবা হোসেন হাওলাদার হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার পোলাডার কী দোষ ছিল? ক্যান ওরে গুলি করা হইলো? গুলিতে মোর পোলাডার বুকটা ঝাঁজরা হইয়্যা গ্যাছে। ও তো কোনো রাজনীতি করত না, ওরে গুলি কইরা কার লাভ হইলো। কেডায় এহোন আমাগোরে দ্যাখবো ? মুই এই খুনের বিচার চাই’।
এ বিষয়ে আঙ্গারিয়া ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ গোলাম মরতুজা জানান, যেহেতু মিলন দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, তাই ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে পরিবারটির দিকে আলাদা নজর রাখা হবে।
দুমকী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহীন মাহমুদ জানান, যেহেতু মিলন হাওলাদার স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন। তাই তার পরিবারের জন্য যা যা করণীয় সব কিছুই উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হবে।