এতিমের গরু বিক্রি করে লুটে নেওয়া টাকা ফেরত দিলেন বিএনপি নেতারা
গাজীপুরের শ্রীপুরে এক দরিদ্র পরিবারের গরু বিক্রি করে আত্মসাত করা টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় বিএনপি নেতা বাবলু সরকার, তার ছোট ভাই কামরুল ও তাদের সহযোগীরা। নানা আলোচনা-সমালোচনা, দলীয় চাপ ও আইনশৃংখলা বাহিনীর তৎপরতার মুখে শনিবার রাতেই টাকা ফেরত দেন অভিযুক্তরা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শ্রীপুর থানা পুলিশ।
এদিকে দরিদ্র পরিবারের গরু জোর করে বিক্রি করে টাকা লুটে নেওয়ার খবরে ভুক্তভোগী পরিবারটির পাশে দাঁড়িয়েছেন সৌদি প্রবাসী মক্কা নগরীর মেসফালা শাখা বিএনপির সভাপতি মো. এমদাদুল হক মোল্লা। আজ রবিবার দুপুরে ভুক্তভোগী পরিবারটিকে তিনি একটি গরু কিনে দেন।
এছাড়া, এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্থানীয় বিএনপি। শ্রীপুর থানায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে।
এর আগে গ্রাম্য সালিসের মাধ্যমে জাহাম্মদ আলী ফকির (৬৫) নামের এক বৃদ্ধার পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন স্থানীয় বিএনপি নেতা ও তার সহযোগীরা। পরে জরিমানার টাকা হাতিয়ে নিতে ওই বৃদ্ধার এতিম নাতির গরু বিক্রি করে দেন। ওই ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নানা আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনা ঘটে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের গলদাপাড়া গ্রামে।
অভিযুক্তরা হলেন- কাওরাইদ ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মো. বাবলু সরকার, তার ছোট ভাই শ্রমিকদল নেতা কামরুল ইসলাম, তাদের সহযোগী একই গ্রামের ইব্রাহীম, রাণা, রমজান-১, রমজান-২, ওসমানসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি।
এ ঘটনার পর গত শনিবার দুপুরে শ্রীপুরে কর্মরত বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের ৪৩ জন প্রতিনিধি উপস্থিত হন জাহাম্মদ আলীর বাড়িতে। ঘটনাটি এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। রাতেই পুলিশ অভিযুক্তদের ধরতে অভিযান চালায়।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ও ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রাতেই উপস্থিত হন জাহাম্মদ আলীরা বাড়িতে। তার হাতে তুলে দেন গরু বিক্রি করে হাতিয়ে নেওয়া টাকা।
ভুক্তভোগী জাহাম্মদ আলী বলেন, ‘ওই নেতাদের হুমকি-ধমকি আর নির্যাতনের ভয়ে কাউকে কিছু বলিনি। সাংবাদিকরা আসার পর সব পাল্টে যায়। রাতে পুলিশ আসে। স্থানীয় মেম্বার ও বিএনপির নেতা সামসুল হক রাতে বাড়িতে এসে গরুর ৩০ হাজার টাকা ফেরত দিয়ে যান।’
সৌদী প্রবাসী ও বিএনপি নেতা এনামুল হক মোল্লা মোঠো ফোনে বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমে জানতে পারি ওই দরিদ্র পরিবারের নির্যাতনের কথা। অসহায় পরিবারের নির্যাতনের বিষয়টি আমাকে ব্যথিত করে। পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে ওই পরিবারকে একটি গাভী দান করেছি।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. মমিনুল কাদের বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর আমরা স্থানীয় গন্যমান্যদের নিয়ে ওই পরিবারের পাশে দাঁড়াই। গরু বিক্রি করে নেওয়া টাকা উদ্ধার করে জাহাম্মদ আলীকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।’
কাওরাইদ ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. এমদাদুল হক মন্ডল জানান, গরু বিক্রি করে নেওয়া টাকা ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে ফেরত দেওয়া হয়েছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জয়নাল আবেদীন মন্ডল বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে অভিযান চালানো হয়। এতে অভিযুক্তরা বুঝতে পেরে আগেই সটকে পড়ে। রাতেই ওই এতিমের গরু বিক্রি করে লুটে নেওয়া টাকা পরিবারকে ফেরত দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় থানায় একটি মামলা হয়েছে।
শনিবার ভূক্তভোগী জাহাম্মদ আলী ফকির (৬৫) ও তার স্ত্রী জামিনা খাতুন জানান, জাহাম্মদ পেশায় ঝাড়ু বিক্রেতা। ঝাড়ু বিক্রি করে কোনো রকমে সংসার পরিচালনা করেন। গত রবিাবর ভোর ৬টার দিকে স্থানীয় ইব্রাহীম ফোন করে জাহাম্মদকে জানান, আল আমীন নামের তার এক আত্মীয় মেয়েসহ আটক হয়েছেন। খবর পেয়ে জাহাম্মদ স্থানীয় তারকাটা বাজারে যান। সেখানে ইব্রাহীম ও তার সহযোগীরা আল আমিনকে ছেড়ে দিতে টাকা দাবি করেন। ওই সময় আল আমিন টাকা দিতে অপারগ হন। পরে আল আমিন ও তার প্রেমিকা স্মৃতিকে ছেড়ে দিতে ১০ হাজার টাকার দিতে হবে বলে জাহাম্মদ আলীকে জিম্মাদার করা হয়। ওইদিন বিকেলের মধ্যে আল আমিন টাকা দিতে না পারায় অভিযুক্তরা জাহাম্মদ আলী ও আল আমিনকে তারকাটা বাজারে ডেকে নেন।
এ সময় অভিযোগ দেওয়া হয়, জাহাম্মদ আলীর বাড়িতে ওই প্রেমিক জুটিকে জায়গা দেওয়া হয়েছিল। এ অভিযোগ এনে তারা বৃদ্ধ জাহাম্মদকে নির্যাতন করেন। এ সময় জাহাম্মদ আলীর কাছে ৫০ হাজার টাকা দবি করেন অভিযুক্তরা। পরে তা কমিয়ে ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন। দরিদ্র জাহাম্মদ টাকা দিতে না পারায় ব্যবসায়ীকে ডেকে জাহাম্মদের বাড়ির গরু বিক্রি করে তারা টাকা নিয়ে নেন।
জাহাম্মদের স্ত্রী জামিনা খাতুন জানান, এতিম নাতি রাকিবুলের বিয়ের জন্য একটা গরু পালন করছিলেন। তাদের ইচ্ছে ছিল, গরুটা বিক্রি করে নাতি রাকিবুলের বিয়েতে খরচ করবেন। কিন্তু অভিযুক্তরা গরুটা বিক্রি করে তার হাতে ৬ হাজার টাকা দেন এবং বাকি টাকা তারা নিয়ে যান।
গোড়ার (গরুর খাবার খাওয়ার স্থান) সামনে দাঁড়িয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে জাহাম্মদ বলেন, ‘একমাত্র এতিম নাতি রাকিবুলকে একটি গরু কিনে দিয়েছিলাম। গরুটি লালন পালন করছিলাম, বড় করে তার বিয়ের টাকা যোগাড় করব। সে ভাগ্য হলো না। বিএনপির প্রভাব খাটিয়ে আমাকে নির্যাতন করল, এরপর বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে এলাকা ছাড়া করার হুমকি দেয়। মিথ্যা অভিযোগে ৫০ হাজার টাকা মূল্যের গরু বিক্রি করে টাকা ভাগ করে নেয় তারা।’
মিথ্যা অপবাদ দিয়ে দরিদ্র পরিবারটির গরু বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।