টাকা দিলেই কাজ পেতেন ঠিকাদার
যুবলীগ নেতা আরশেদুল আলম বাচ্চুর মূল ব্যবসা ছিল বিলবোর্ড। সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ১৭ বছর এবং পরবর্তীতে মনজুর আলমের ৫ বছর তিনি নির্ভয়ে এই ব্যবসা করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক)। আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়রের দায়িত্ব নিয়েই চট্টগ্রাম শহরের সব বিলবোর্ড উচ্ছেদ করে ফেলেন। এতে বাচ্চুসহ সব বিলবোর্ড ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ২০২০ সালে আ জ ম নাছিরের স্থানে রেজাউল করিম চৌধুরীকে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আরশেদুল আলম বাচ্চু ছিলেন অতি মাত্রায় সক্রিয়। এমনকি মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে দলীয় মনোনয়নপত্র কেনার ৩০ হাজার টাকাও বাচ্চুই দিয়েছিলেন। এর ফল হিসেবে বাচ্চু ৭২ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ করছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক)। ফিরিয়ে আনেন বিলবোর্ড ব্যবসাও। নগরীর জিইসি মোড়সহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শোভা পায় বাচ্চুর বিলবোর্ড।
সরকারের নির্বাহী আদেশে পদচ্যুত সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অনেক নতুন ও পুরাতন ঠিকাদারকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার মাধ্যমে নিয়ম না মেনে কাজ ভাগ-বাটোয়ারা করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর টানা দুদিন নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায় অবস্থিত রেজাউল করিম চৌধুরীর দুইটি বাড়ি লুট হয়। এর মধ্যে পৈতৃক দুইতলা বাড়ি এবং মেয়র হওয়ার
পর রাতারাতি নির্মিত ছয়তলা বাড়ির প্রতিটি কক্ষই লুট করে দুর্বৃত্তরা। সেইসময় রেজাউল করিম চৌধুরীর বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা লুট হওয়ার খবর প্রচারিত হয়। টানা দুদিন লুটের পর দুর্বৃত্তরা বাড়ি দুটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
তবে রেজাউল করিম চৌধুরীর দায়িত্ব পালনকালীন আরশেদুল আলম বাচ্চুর মতো খুব কম দলীয় লোকজনই নিজেদের ভাগ্যবান ভাবতে পেরেছেন। চসিকের ঠিকাদারি কাজ বরাদ্দের ক্ষেত্রে যার কাছ থেকেই নগদ টাকা পেয়েছেন রেজাউল করিম চৌধুরী তাকেই কাজ দিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। ওই সময় ঠিকাদাররা রেজাউল করিম চৌধুরীকে মিস্টার টেন পারসেন্ট হিসেবেও নামকরণ করেন। চসিকের ঠিকাদার সমিতির সাবেক উপদেষ্টা ও প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার মো. জসিম উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, রেজাউল করিম চৌধুরী টাকার বিনিময়ে ঠিকাদারদের কাজ দিয়েছেন। আমরা টাকা দেই নাই, তাই সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময়ে তিনি আমাদের একটি কাজও দেননি।
মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় রেজাউল করিম চৌধুরী ও যুবলীগ নেতা আরশেদুল আলম বাচ্চুর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চট্টগ্রাম শহরের উন্নয়নে ২৪৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি একনেকে অনুমোদন পায় চসিকের এই প্রকল্প। রেজাউল করিম চৌধুরী দায়িত্বে থাকাকালীন পর্যন্ত মোট ১৬০০ কোটি টাকার কার্যাদেশ দিয়েছেন। অবশিষ্ট কাজের বরাদ্দ দেওয়ার আগেই হাসিনা সরকারের পতন হয়। নির্বাহী আদেশে রেজাউলও পদচ্যুত হন।
চসিকে সম্প্রতি তথ্য অধিকার আইনের আওতায় এসব ঠিকাদারি কাজের বরাদ্দ সংক্রান্ত একটি আবেদন করা হয়। ওই আবেদনে চসিকের পক্ষ থেকে ১২১০ কোটি টাকার কাজের বরাদ্দ সংক্রান্ত লিখিত উত্তর দেওয়া হয়। তাতে দেখা যায়, অতীতে যেসব ঠিকাদার দীর্ঘ সময় ধরে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন, তারা অনেকেই কাজ পাননি। আবার আওয়ামী লীগের দলীয় বেশিরভাগ ঠিকাদারও ঘেঁষতে পারেননি রেজাউলের কাছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব ঠিকাদার কাজ পাওয়ার স্বার্থে একজনকে একটির বেশি কাজ না দেওয়ার মৌখিক অনুশাসন জারি করেছিলেন। রেজাউল করিম তা মানেননি। তিনি গুটিকয়েক ঠিকাদারকেই কাজগুলো ভাগাভাগি করে দেন। চসিকে নিবন্ধিত ঠিকাদারের সংখ্যা ৩৪৬ জন। কিন্তু ৬/৭ জন ঠিকাদার লটে বেশিরভাগ কাজ নিয়ে নিয়েছেন।
চসিক থেকে দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, দি কনস্ট্রাকশন ট্রেড নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক আলাউদ্দিন মোল্লা ১০টি কাজ পেয়েছেন যার আর্থিক মূল্য ৫৭ কোটি টাকা। রেজাউল করিম চৌধুরীর পাড়ার ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত হেলাল, কামাল ও অনিক যৌথভাবে পেয়েছেন ৩৫৮ কোটি টাকার কাজ। এরমধ্যে বারইপাড়া থেকে কর্র্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খননের ২৪০ কোটি টাকার একটি কাজ তাদের দেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এই যৌথ ঠিকাদারিতে নানা ছল চাতুরীর আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের আদ্যাক্ষর পরিবর্তন করে অনেকগুলো ফার্ম দেখিয়ে যৌথভাবে কাজ ভাগাভাগি করা হয়েছে। যেমন এমএএস-এমআরএসটি, এমএস-এমবি (জেবি), এএস-আরএস-এমবি (জেবি) এ ধরনের অনেক প্রতিষ্ঠানকে চসিকের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাতারাতি তালিকাভুক্ত করে কাজ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বারইপাড়া খাল খনন ছাড়াও এই গ্রুপকে ১৮টি লটে ১১৮ কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে।
প্রগতি নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ৬০ কোটি টাকার কাজ। চসিকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুখ রক্ষার জন্য রেজাউল করিম চৌধুরী আওয়ামী লীগের ঠিকাদারদের কাজ দিলেও একটি কাজ চার থেকে পাঁচ জনের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন।
তবে এসব কাজের মধ্যে ৮০০ কোটি টাকার কাজ এখনও শুরুই হয়নি বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম আমাদের সময়কে বলেন, অনেক কাজের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজ শুরু হয়নি। আমি ইতোমধ্যে প্রকল্পের পরিচালকের সঙ্গে বসেছিও। ঠিকাদারদের কাজ করতে হবে। কীভাবে এটা শুরু করা যায়, সে বিষরে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।