সৌরভ নয়, লুট-দুর্নীতির দুর্গন্ধ ছড়াতেন গোলাপ

এসআর শফিক স্বপন, মাদারীপুর
২৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
সৌরভ নয়, লুট-দুর্নীতির দুর্গন্ধ ছড়াতেন গোলাপ

মাদারীপুর-৩ (মাদারীপুর-কালকিনি ডাসার ও মাদারীপুর সদরের কিছু অংশ) সংসদীয় আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুস সোবহান গোলাপ। ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর মাদারীপুরের কালকিনি ও ডাসার উপজেলায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। হয়ে ওঠেন গডফাদার। তার ইশারায় চলত এলাকায় সব কর্মকা-। সরকারি বরাদ্দ আত্মসাৎ, মনোনয়ন-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, জমি দখল, সরকারি চাকরিতে লোক নিয়োগ, বদলি বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক ফ্ল্যাট, জমি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে গোলাপের। শুধু দেশেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটিতে কিনেছেন ৯টি বাড়ি। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় শতকোটি টাকা। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রয়েছে কয়েকশ কোটি টাকা। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠানোর অভিযোগ করেছে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আব্দুস সোবহান গোলাপের বাবা ছিলেন দরিদ্র কৃষক। এলাকায় জমিজমাও তেমন ছিল না। জীবিকার তাগিদে আশির দশকে পাড়ি জমান আমেরিকায়। সেখানে গাড়িচালকের চাকরি নেন। এরপর পিৎজা তৈরি করে বিক্রি শুরু করেন। একপর্যায়ে গোলাপের সঙ্গে পরিচয় হয় শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের। পরিচয় থেকে গভীর সম্পর্ক। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তার। জয়ের পরামর্শে চলে আসেন দেশে। ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সচিব এবং ২০১৪ সালে বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পান। ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক পদ নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৮ সালে দলীয় মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়ে মাদারীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

নির্বাচনী হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে গোলাপের নিজের ও স্ত্রীর অর্থসম্পদ চারগুণের বেশি বেড়েছে। ২০১৮ সালে তার নিজের নামে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৩৩ লাখ ৬২ হাজার ৪১৭ এবং স্ত্রীর নামে ৫১ লাখ ৯ হাজার ৬৯০ টাকা জমা ছিল। ২০২৩ সালে তার জমা অর্থের পরিমাণ হয় এক কোটি ৪৫ লাখ ৩ হাজার ৯৩১ টাকা এবং স্ত্রীর ২৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৩৮ টাকা। ২০১৮-এর হলফনামা অনুযায়ী তার স্ত্রীর কাছে ৯৮ হাজার ১১৮ ইউএস ডলার থাকার কথা জানানো হলেও ২০২৩ সালে কোনো বৈদেশিক মুদ্রার কথা উল্লেখ করা হয়নি। প্রথম হলফনামার তার কোনো গাড়ি ছিল না। ২০২৩ সালে একটি টয়োটা হ্যারিয়ার জিপের কথা উল্লেখ করা হয়। যার বাজারমূল্য দেওয়া হয়েছে ৯০ লাখ ৬৪ হাজার ২৪৭ টাকা। কয়েক বছর আগে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে এসব বাড়ি কিনেছেন। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় একশ কোটি টাকা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও ক্ষমতার অপব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন গোলাপ। এমপি হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি যে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এটি তার প্রতিবেশীরাও জানতেন না। মাদারীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার হারুন শরীফ বলেন, আব্দুস সোবহান গোলাপ একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। আমরা কখনও তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিনতাম না। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এমন কথাও শুনিনি। শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুনেছি আব্দুস সোবহান গোলাপ মুক্তিযোদ্ধা।

স্থানীয়রা জানান, এলাকায় গোলাপের পরিবারের জমিজমা তেমন কিছুই ছিল না। এমপি হওয়ার পর দখলবাজি করে অনেক জমির মালিক হয়েছেন। আত্মীয়স্বজনের জমিও দখল করেছেন। কেউ প্রতিবাদ করলেই মামলা হামলা করে বাড়িছাড়া করা হতো। দখল জমি ফেরত পেতে ৫ জন মাদারীপুর আদালতে গোলাপের বিরুদ্ধে মামলা করেও কোনো প্রতিকার পাননি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ক্ষতিগ্রস্ত এবিএম সালাহ উদ্দিন, জুলহাস বেপারী, শাহীন সুলতানা, মাসুম বেপারী, মনজুয়ারা বেগম, মুজিবুর রহমান, শাহনাজ বেগম, মশিউর রহমান, মো.কামরুজ্জামানসহ ১০ ব্যক্তি গোলাপের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ করেছেন।

এবিএম সালাহ উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি ক্ষমতা দেখিয়ে দখল করে নিয়েছেন গোলাপ। আদালতে মামলা দিয়েও প্রতিকার পাইনি। আশা করি এখন ন্যায়বিচার পাব।’

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা এবিএম নুরুল আলমের পৈতৃক জমিও দখল করেছেন গোলাপ। এ ঘটনায় আদালতে মামলা করেছেন বলে জানান নুরুল আলম।

এদিকে গোলাপের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দলীয় প্রতীক পাইয়ে দিতে প্রতিটি ইউনিয়নে একাধিক প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিতেন গোলাপ। একজনকে মনোনয়ন দিয়ে বাকিদের টাকা ফেরত দিতেন না। সিরাজ নামে একজন জানান, মনোনয়ন দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছেন গোলাপ। কিন্তু তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি আবার টাকাও ফেরত দেয়নি। এ ছাড়া দলের জেলা, উপজেলা ও পৌরসভায় বিভিন্ন কমিটিতে দলীয় পদ দেওয়ার কথা বলেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন গোলাপ। মুরাদ সরদার নামে কালকিনির সাহেবরামপুর এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, পদ দেওয়ার কথা বলে টাকা তার কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছেন গোলাপ। কিন্তু তাকে পদ দেওয়া হয়নি।

টিআর কাবিখা বরাদ্দেও নানা অনিয়ম করেছেন গোলাপ। তার স্ত্রী গুলশান আরার নামেও টাকা তুলেছেন। টিআর ও কাবিখার কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি।

সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় গোলাপের বিরুদ্ধে দলীয় নেতাকর্মীরাও কথা বলার সাহস পেত না। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মাদারীপুর আদালতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যার ঘটনায় গোলাপের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। তবে ঢাকার একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন তিনি।