আইসিটি খাতের মাফিয়া পলক গড়েছেন সম্পদের পাহাড়
সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের বিরুদ্ধে গত ১৫ বছরে হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। দেশে-বিদেশে রয়েছে নামে-বেনামে বিপুল সম্পত্তি। আইসিটি খাতে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, নিয়োগ বাণিজ্য আর বিশেষ বরাদ্দ টি-আর, কাবিখা-কাবিটা প্রকল্পের নামে অর্থ লুটের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এসব অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কেউ পলকের বিরুদ্ধে কোনো কথাও বলতে পারেননি।
পলক এসব অবৈধ সম্পদ অর্জন করতে বাবা-মার নামও ব্যবহার করেছেন। শুধু পলক নয়, অবৈধ সম্পদ অর্জনে স্ত্রী-শ্যালকসহ তার ফাইভ স্টার বাহিনীর সদস্যদেরও কাজে লাগিয়েছেন। সিংড়া উপজেলার ১২ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরাও তার আশির্বাদে হয়েছেন কোটি কোটি টাকা ও গাড়ি-বাড়ির মালিক।
সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পরই এলাকায় ফাইভ স্টার বাহিনী গড়ে তুলে সমালোচনার মুখে পড়েন। পলক নিজে হাজারো অনিয়ম ও দুর্নীতি করেও লোক দেখানো গণশুনানির মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতেন এবং বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের করতেন নানাভাবে নাজেহাল।
পলকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পিএস, এপিএস, পিএ তারাও গড়েছেন বিপুল সম্পদ ও অট্রালিকা। এরমধ্যে রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রুহুল আমিন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি মাদ্রাসার শিক্ষকতা ছেড়ে পলকের ব্যক্তিগত সহকারী হয়ে নিয়োগ বাণিজ্য ও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে গড়ে তোলেন একক অধিপত্য। আরেক ব্যক্তিগত সহকারী রাকিবুল ইসলাম। ব্যক্তিগত সহকারী নিয়োগের পর পলকের আইসিটি দপ্তরের সকল কার্যক্রম তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। দপ্তরের সকল প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি ও নিয়োগ বাণিজ্য ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। তিনিও এলাকায় বাড়ি-গাড়ি ও সম্পদ গড়েছেন। সরকার পতনের পর জনরোষে সবাই গা ঢাকা দিয়েছেন।
জানা গেছে, জুনাইদ আহমেদ পলকের বাবা ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ ১৯৭৫ সালে সিংড়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে দল পরিবর্তন করে ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। বাবার প্রথম রাজনীতির সূত্র ধরে পলকের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে প্রবেশ। পরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেন তিনি। নাটোর-৩ সিংড়ার আসনে মনোনয়নপ্রাপ্ত উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহজাহান আলীর আকস্মিক মৃত্যুর পর ২০০৮ সালে এই আসনে মনোনয়ন পান নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হানিফ আলী শেখ। পলকের এক ভাতিজীসহ ঢাকায় অধ্যায়নরত এলাকার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আন্দোলন করে সেই মনোনয়ন পরিবর্তন করেন। নাটোর-৩ (সিংড়া) আসনে পলক দেশের সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য (এমপি) প্রার্থী হিসেবে দলীয় মনোনয়ন পান এবং নির্বাচিত হন।
হলফনামা অনুযায়ী প্রথম নির্বাচনে তিনি প্রায় সব টাকা ব্যয় করেন ধার দেনা করে। তখন তার মাত্র এক বিঘা কৃষি জমি আর ১৮ শতাংশ ভিটা জমি ছিল। ২০১৮ সালে সম্পত্তি নিজ নামে ২১ কোটি ১৮ লাখ চার হাজার ৩৯২ টাকা ও স্ত্রীর নামে ১০ কোটি ৬৫ লাখ ২ হাজার ৭৮৮ টাকা। ২০২৩ সালে নিজ নামে ৩২ কোটি ২৩ লাখ ৬ হাজার ১৭৭ টাকা ও স্ত্রীর নামে ২৬ কোটি ২৬ লাখ ৮ হাজার ৬২৬ টাকা।
পরবর্তী ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সিংড়ার এই আসন থেকে সংসদ সদস্য হন তিনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে সখ্যতার কারণে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান পলক। শেখ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মাধ্যমে সব দপ্তরে দুর্নীতি করে পার পেয়ে যান পলক। গড়েন সম্পদের পাহাড়।
পলকের স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা প্রথমে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও পরে সিংড়া দমদমা স্কুল এন্ড কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করলেও কখনো কোনো ক্লাস পরীক্ষায় অংশ নেননি। কোনো ব্যবসা করেন এমন কথা শোনা না গেলেও তিনি কোটি কোটি টাকা, ৩০ ভরি স্বর্ণ ও অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান। স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা দুই বার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আমেরিকা গিয়ে সন্তান প্রসব করে বাগিয়ে নেন সেখানে সন্তানদের নাগরিকত্ব।
পলক শুধু তার নিজ এলাকা সিংড়া উপজেলাতেই দৃশ্যমান অনেক সম্পদ গড়েছেন। এর মধ্যে বড় ছেলে অপূর্ব জুনাইদের নামে জামতলী-বামিহাল রাস্তা সংলগ্ন চওড়া গ্রামে জনৈক লিটন নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৪২ বিঘা পুকুর ও আম বাগান কিনেছেন, যা চওড়া মৌজার দাগ নম্বর: ১৯০, ১৯১, ১৯২, ১৯৩, ১৯৮, ১৯৯, ২০০, ২০১, ২০২, ২১১, ২১৪, ২১৫, ২৯৩, ৩০৮, ৩০৯, ৩৪৪, ৫৬২ ।
নিজের মা জামিলার নামে সুকাশ ইউনিয়নে আগমুরশন গ্রামে হেদায়েতুল্যা প্রামাণিকের নিকট থেকে ৩৬ বিঘা পুকুরসহ বাগান কিনেছেন, যার খতিয়ান নম্বর: ২০৮, জেএল নম্বর: ১১৩, আগমুরশন মৌজার দাগ নম্বর: ৭০২, ৭৯৬, ৭৯৭, ৭৯৮, ৭৯৯, ৮০০, ৮০১। মোট সাতটি দাগে ১২ একর ২৯ শতক জায়গার মধ্যে ১২ একর মা জামিলার নামে ক্রয় করেছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলক। সিংড়া পৌরসভার উপ-শহর এলাকায় স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা ও শ্যালক লুৎফুল হাবীবের নামে দুই কোটি টাকা মূল্যের দুটি পৃথক বাড়ি। শহরের মাদারীপুর ও চাঁদপুর রাস্তা সংলগ্ন এলাকায় স্ত্রীর নামে প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের ১৫ শতক মার্কেটের জায়গা কিনেছেন, যা কাটাপুকুরিয়া মৌজার দাগ নম্বর: ৩৫১।
জেলা সদরে নাটোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যে জায়গাসহ মা জামিলা বেওয়া, স্ত্রী কনিকা ও স্বজনদের নামে-বেনামে সম্পত্তি। চলনবিলের বিভিন্ন মাঠে ৫০০ থেকে ৭০০ বিঘা সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়াও ঢাকা শহরেও বিভিন্ন নামে কোটি কোটি টাকার ফ্ল্যাট-বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিনেছেন বলে জানা গেছে। দেশের বাইরে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পলক দম্পত্তির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি-গাড়ি রয়েছে।
সিংড়া বাজারের বাসিন্দা স্ট্যাম ভ্যান্ডার আজম হক জানান, পলক এমপি হওয়ার পর আলাদ্দিনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান। তাতে ঘষা দিয়ে গত ১৫ বছরে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
সিংড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পলকের ফাইভ স্টার বাহিনীর সদস্য জান্নাতুল ফেরদৌসের বিরুদ্ধেও অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ফেরদৌসের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাসহ নির্যাতন করারও অভিযোগ আছে।
সিংড়া উপজেলার বাসিন্দা মোকলেছ কসাই বলেন, তিনি পেশায় ছিলেন একজন কসাই। ফেরদৌস তাকে নির্যাতন করে দেশান্তরী করেছিল। তার ভয়ে পালিয়ে জীবন কেটেছে কয়েক বছর। নতুন করে স্বাধীনতা হওয়ার পর তিনি সিংড়াতে ফিরে এসেছেন।
পলক নিজের ক্ষমতার দ্বিগুণ করতে নির্বাচনী এলাকায় বিএনপির কিছু নেতাদেরও দিয়েছেন সুবিধা। স্বল্প সুদে লোন করিয়ে দিতেন পলক। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তদবির করে ছাড়িয়ে দিতেন পলক।
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর পলকও পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বিদেশে পালানোর সময় বিমান বন্দরে গ্রেপ্তার হন তিনি।
এদিকে সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের গ্রেপ্তারের আগেই তার স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা, তিন সন্তান অপূর্ব, অর্জন ও অনির্বাণ এবং শ্যালক রুবেল দেশের বাহিরে পাড়ি জমান। বিদেশে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় পলকের স্ত্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সংক্ষিপ্ত একটি ভিডিও ছেড়েছেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য সঠিক নয়। বরং তিন ছেলে, শাশুড়ি ও প্রতিবন্ধী ননদকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেছেন।
চলনবিলের মানুষদের দাবি এমন বক্তব্য তামাশা ছাড়া আর কিছুই না।