এনআরবিসি ব্যাংকে গুরুতর অনিয়ম
এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংকে গ্রাহকের সঞ্চয়ী হিসাবে সন্দেহজনক লেনদেন, উদ্যোক্তা পরিচালকের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান এবং নিয়মের বাইরে গিয়ে অনিবাসী উদ্যোক্তাদের বেশি শেয়ার ধারণ করাসহ বেশ কিছু গুরুতর অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি পরিচালিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অনিয়মের বিষয়ে ব্যাংকটিকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই সঙ্গে এর সঙ্গে জড়িত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, সেজন্য কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত সপ্তাহে এনআরবিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দিয়ে এই জরিমানা ও কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। এতে ব্যাংকটির সব পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি সচিবকে কারণ দর্শাতে বলা হয়। এ ছাড়া ৩০ দিনের মধ্যে ব্যাংকের সব অনিবাসী উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারদের আইনানুগ আবাসিক মর্যাদা পুনঃযাচাই করা এবং অনিবাসী উদ্যোক্তাদের শেয়ার ধারণ নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রদানের বিষয়ে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, সেটিও জানতে চাওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য ব্যাংকটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রবিউল ইসলামের মোবাইলে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরেও কল করা যায়নি। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, প্রবাসী আয় আনাসহ বেশ কয়েকটি শর্ত দিয়ে ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল প্রবাসী উদ্যোক্তাদের জন্য তিনটি ব্যাংক অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে অন্যতম এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। ২০১৩ সালে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করা ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার ফরাছত আলী। তার মেয়াদে পরিচালকদের স্বাক্ষর জাল করে ঋণ অনুমোদন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মিথ্যা তথ্য প্রদান, বেনামি শেয়ার ধারণের সুযোগ দেওয়াসহ নানা অভিযোগ ওঠে। এর ফলে ফরাছত আলীকে সরিয়ে ২০১৭ এর পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়। তখন ব্যাংকটির পরিচালনার দায়িত্বে আসেন পারভেজ তমাল। এরপর থেকে ব্যাংকটির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ পারভেজ তমালের হাতেই রয়েছে। তার সময়েও ব্যাংকটিতে নানা অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। তারপরও বহাল তবিয়তে রয়েছেন তিনি।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকটির চট্টগ্রামের ও আর নিজাম রোড শাখার হিসাবধারী মো. রেজাউল বশির চৌধুরীর অ্যাকাউন্টে দীর্ঘদিন ধরে অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক লেনদেন সংগঠিত হয়। তার হিসাব নম্বর ০১১৮৩১১২৬৭৩। অ্যাকাউন্টে সন্দেহজনক লেনদেন হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকটি দেশের কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) না জানিয়ে গোপন রেখেছে। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের শাখা কর্তৃক সন্দেহভাজন লেনদেন বা কার্যক্রম চিহ্নিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা শাখা মানিলন্ডারিং কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানাতে হবে। মানিলন্ডারিং শাখা কর্মকর্তা তা যথাযথ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে সংরক্ষণ করবেন। লেনদেন বা কার্যক্রমটি যদি সন্দেহজনক হয়, তাহলে তা দ্রুত প্রয়োজনীয় দলিলসহ মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসীকার্যে অর্থায়ন প্রতিরোধ বিভাগে পাঠাতে হবে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ও আর নিজাম রোড শাখার হিসাবধারী মো. রেজাউল বশির চৌধুরীর অ্যাকাউন্টে দীর্ঘদিন ধরে অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক লেনদেন সংঘটিত হলেও ব্যাংকটি যথাযথ সময় রিপোর্ট করেনি। এই অপরাধে এনআরবিসি ব্যাংককে মানিলন্ডারিং আইন ২০১২ (২০১৫ সাল পর্যন্ত সংশোধিত) এর ২৫ (২) (ক) ধারায় ৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই জরিমানার অর্থ চিঠি পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। যথাযথ সময়ে অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে তা ব্যাংকটির রক্ষিত হিসাব থেকে কর্তন করা হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
এ ছাড়া ২০২১ সালের ১৮ মে হতে ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ও আর নিজাম রোড শাখার দায়িত্ব পালনকারী শাখা ব্যবস্থাপক, শাখা মানিল্ডারিং প্রতিরোধ পরিপালন কর্মকর্তা, ব্যাংকের প্রধান মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ পরিপালন কর্মকর্তা এবং মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়ন প্রতিরোধ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ সংঘটিত লেনদেনের সঙ্গে জড়িত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়-দায়িত্ব নিরূপণপূর্বক তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে পত্র প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অবহিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, এনআরবিসির উদ্যোক্তা পরিচালক আবু বকর চৌধুরীর জাতীয় পরিচয়পত্র-সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যাখ্যায় ব্যাংকের নিকট ২০১৮ সালের ১৪ মে তারিখে প্রদানকৃত জাতীয় পরিচয়পত্রের কোনো রেকর্ড সংরক্ষিত নেই মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর তারিখ স্থিতিভিত্তিক বিশদ পরিদর্শনে এবং আর নিজাম রোড শাখায় আবু বকর চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বায়েজিদ স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজের নথিতে সরকার কর্তৃক ২০১৮ সালের ১৪ মে তারিখে ইস্যু করা ১৫৯৪৩০৮৬৮৫১৪৪ নম্বর সম্বলিত জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি সংরক্ষিত রয়েছে। এ ছাড়া তার প্রতিষ্ঠানের হিসাব খোলার ফরমে মালিকের ব্যক্তিগত তথ্যের অংশে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বরের উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ আবু বকর চৌধুরী কর্তৃক ব্যাংকটির উদ্যোক্তা শেয়ার ক্রয়ের সময় ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রদত্ত ঘোষণাপত্র ও অঙ্গীকারপত্রে তার জাতীয় পরিচয়পত্র ‘নেই’ মর্মে উল্লেখ করে ব্যাখ্যায় ‘ব্যাংকের নিকট ২০১৮ সালের ১৪ মে তারিখে প্রদানকৃত জাতীয় পরিচয়পত্রের কোনো রেকর্ড মজুদ নেই’ মর্মে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
চিঠিতে বলা হয়, এমন অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংককে মিথ্যা তথ্য প্রদানের কারণে আবু বকর চৌধুরীসহ সকল পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং কোম্পানি সচিবসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরূদ্ধে কেন ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০২৩ সাল পর্যন্ত সংশোধিত) এর ধারা ১০৯(২) এর আওতায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, সে বিষয়ে পত্র প্রাপ্তির ১৪ দিনের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য পৃথকভাবে কারণ দর্শানোর জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হলো।
চিঠিতে আরও বলা হয়, আপনাদের ব্যাখ্যানুযায়ী বর্তমানে এনআরবিসি ব্যাংকের ৬৮ দশমিক ০৬ শতাংশ শেয়ার উদ্যোক্তা পরিচালক এবং ৩১ দশমিক ৯৪ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারী ধারণ করছেন, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দলের নিকট সরবরাহ করা এনআরবিসি ব্যাংকের ২০২৩ সালের ৩ জানুয়ারি তারিখের শেয়ারহোল্ডিং রিপোর্টের তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এমন অবস্থায় শেয়ার হোল্ডিংয়ের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট মিথ্যা তথ্য প্রদান করার কারণে আপনাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০২৩ সাল পর্যন্ত সংশোধিত) এর ধারা ১০৯ (২) এর আওতায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, সে বিষয়ে পত্র প্রাপ্তির ১৪ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা প্রদান করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হলো। সেই সঙ্গে পত্র প্রাপ্তির ৬ মাসের মধ্যে আপনাদের ব্যাংকের অনিবাসী উদ্যোক্তা কর্তৃক ধারণকৃত শেয়ারের শতকরা হার অনধিক ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হলো।
চিঠিতে আরও বলা হয়, এ সময়ের মধ্যে এ নির্দেশনা পালনে ব্যর্থ হলে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০২৩ সাল পর্যন্ত সংশোধিত) এর ধারা-৩১ উপধারা (৫) (খ) এর আওতায় আপনাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া ৩০ দিনের মধ্যে এনআরবিসি ব্যাংকের সকল অনিবাসী উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারদের আইনানুগ আবাসিক মর্যাদা পুনঃযাচাই করে প্রমাণক দলিলাদিসহ একটি প্রতিবেদন প্রেরণ করার জন্য পরামর্শ প্রদান করা হলো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, দেশে ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনার লক্ষ্যে লাইসেন্সের ৪ নম্বর শর্ত পালনেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এনআরবিসি ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে তাদের অদক্ষতা ও দায়িত্বে অবহেলার দায়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পত্র প্রাপ্তির এক মাসের মধ্যে যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক তার প্রমাণক দলিলাদি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করার জন্য পরামর্শ প্রদান করা হলো।