জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিতে ন্যায়সংগত অর্থায়ন বৃদ্ধির প্রস্তাবনা
দেশটি এক বিশাল জলবায়ু অর্থায়ন ঘাটতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। উন্নত দেশগুলোর অর্থ সাহায্য কিছু আর্থিক সমস্যার সমাধান করলেও প্রকৃত জলবায়ু ন্যায়বিচার হবে না। দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিনিয়োগের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যহারে বাড়াতে হবে। জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন ও প্রশমন কৌশলগুলো ন্যায়সংগত হতে হবে এবং সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য দিতে হবে।
আসন্ন আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন (কপ২৯) সামনে রেখে আয়োজিত ‘রোড টু বাকু-কপ২৯- জলবায়ু সহনশীলতায় বাংলাদেশের নাগরিক সংগঠনের অবস্থান’ শীর্ষক সেমিনার থেকে এসব প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
আজ রবিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত পরিবেশ অধিদপ্তরে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দেশের ২০টি নাগরিক সংগঠন।
এ সময় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদ। এছাড়াও একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির, নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম) এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. এসএম মঞ্জুরুল হান্নান খান উপস্থিত ছিলেন। এসময় সেমিনারে বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন, জলবায়ু কর্মী এবং নীতি বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ কপ২৯-এ জলবায়ু অর্থায়ন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি, ঋণ মোচনের কৌশল প্রস্তুত, এবং ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তরের জন্য জোরালো দাবি উত্থাপন করা হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি বছর আনুমানিক ৪৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন, যা বর্তমানে প্রতিশ্রুত এবং অপর্যাপ্তভাবে অর্থায়িত ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তুলনায় অনেক বেশি। এই আর্থিক সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ জলবায়ু পরিবর্তন ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপি প্রায় ৯.৮ শতাংশ কমিয়ে দেওয়ার হুমকি সৃষ্টি করেছে এবং শুধু ২০২১ সালেই ১১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি করেছে (বিশ্বব্যাংক, ২০২১)।’
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পুনর্ব্যক্ত করেন যে, বাংলাদেশ বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার বিষয়ে দৃঢ় অবস্থানে থাকবে। তিনি অভিযোজন পদক্ষেপের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং তরুণদের এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার আহ্বান জানান। এছাড়া, আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরা এবং উচ্চাভিলাষী প্রশমন উদ্যোগ নিয়ে কথা বলার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।
কপ২৯ সম্মেলনের আগে, বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণের গুরুত্বও তিনি তুলে ধরেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদ বলেন, দেশে জলবায়ু অভিযোজনে বেশি ফান্ডিং হওয়া দরকার। সামনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই বিষয়টা নিয়ে জোরালো দাবি জানাতে হবে। অভিযোজনের ১০ বিলিয়ন ডলারের ফান্ডে আমরা মাত্র একটি প্রজেক্ট পেয়েছি। এখানে জোর দিতে হবে।
একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় বিশেষত নারী, শিশু, তৃতীয় লিঙ্গ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। জলবায়ু অর্থায়নটা শুধু জেন্ডার সংবেদনশীল হলেই হবে না তা হতে হবে জেন্ডার রেসপন্সিভ। সামনের জলবায়ু সম্মেলনে পানি সংকটের বিষয়টি জোর দিতে হবে। নারী ও শিশুদের ওপর যে এর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে তা জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কমিউনিটির মানুষের মানসিক বিপর্যয়কে আলাদাভাবে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। ’
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম) এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. মঞ্জুরুল হান্নান খান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনে ভুক্তভুগী মানুষের কষ্ট প্রশমন করা ছাড়া কোনো উপায় নাই। যদিও কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশ খুবই নগণ্য অবদান রাখছে, সেই তুলনায় অভিযোজন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এজন্য আমাদের অনেক বেশি জলবায়ু অর্থায়ন প্রয়োজন। একইসঙ্গে জ্ঞান-প্রযুক্তির বিনিময় প্রয়োজন।
সেমিনারের মূল লক্ষ্য ছিল আসন্ন কপ২৯ সম্মেলনের আলোচনা পর্বে বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের একটি একক অবস্থান গঠন ও আলোচ্য বিষয়গুলো সুস্পষ্ট করা। এ সময় অনুষ্ঠানে জলবায়ু অর্থায়নের নানা বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তানজিয়া আনজুম, রউফা খানম, এম জাকির হোসেন খান, মো. সালাহ্ উদ্দিন, রুবাইয়া নাসরিন সেজুতি ও ফারিহা অমি।
অনুষ্ঠানের শেষে কপ২৯ সম্মেলনে জোরালো অ্যাডভোকেসির আহ্বান জানানো হয়, যাতে বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর কণ্ঠস্বর শোনা যায়। বিশেষত নারীদের এবং যুবকদের অন্তর্ভুক্ত করে অভিযোজন এবং প্রশমনের জন্য আরও শক্তিশালী পদপক্ষেপ গ্রহণ, লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল কার্যকরকরণ, জীবাশ্ম জ্বালানিতে অর্থায়ন বন্ধ করে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে বিনিয়োগ বৃদ্ধির আহ্বান জানানো হয়।
একইসঙ্গে উপস্থিত প্রতিনিধিরা আশা প্রকাশ করেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং সহনশীলতা গঠনে বাংলাদেশ উদাহরণ সৃষ্টি করবে।
অনুষ্ঠানে এ সময় বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তা, জলবায়ু ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, নীতি বিশেষজ্ঞ, জলবায়ু কর্মীসহ গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।