সুজেয় শ্যাম ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

তিমির নন্দী, সংগীতশিল্পী
২০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
সুজেয় শ্যাম ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

বিখ্যাত সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম বৃহস্পতিবার রাতে চলে গেছেন না ফেরা দেশে। তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তারই সহযোদ্ধা তিমির নন্দী

যদিও আমি ১৯৬৫ সালে রেডিও পাকিস্তান, রাজশাহীতে অডিশন দিয়ে পাস করেছিলাম। কিন্তু ১৯৬৯ সালে ইস্ট পাকিস্তান মিউজিক কম্পিটিশনে ছোটদের গ্রুপে আধুনিক গানে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক এবং পল্লীগীতিতে দ্বিতীয় হয়ে রৌপ্যপদক পাওয়ার পর থেকেই রেডিও পাকিস্তান, শাহবাগ ঢাকা থেকে সংগীত পরিবেশন করে আসছি। আমাদের সংগীতাঙ্গনের তথা দেশের গর্ব, বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সংগীত পরিচালক, সদ্য প্রয়াত শ্রদ্ধেয় সুজেয় শ্যামদার সঙ্গে তখন দেখা হয়। উনি আমার প্রথম দিনের পরিবেশনায় আমার গানে গিটার বাজিয়েছিলেন। জেনেছিলাম, তিনি যন্ত্রশিল্পী হয়ে চট্টগ্রাম রেডিও থেকে বদলি হয়ে ঢাকায় এসেছেন।

রেডিওতে ছোটদের আসরে নিয়মিত অনুষ্ঠান করতাম। শিমুল বিল্লাহ (ইউসুফ), শেলু বড়ুয়া, আবিদা সুলতানা, পিয়ারু, নাশিদ কামাল, মিলি, বিনু আরও অনেকে। তখন শ্যামদার সুরে অনেক গান করেছি। আগের দিন রিহার্সেল করে পরদিন সরাসরি রেডিওতে গাইতে হতো।

এর পর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলকাতার ৫৭/৮, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে দেখা হলো শ্যামদার সঙ্গে। ওখানে তার সঙ্গে আরও যারা ছিলেন তাদের মধ্যে শ্রদ্ধেয় সমর দাস, অজিত রায়, মো. আব্দুল জব্বার, রথীন্দ্রনাথ রায়, আপেল মাহমুদ, কাদেরী কিবরিয়া, অরূপ রতন চৌধুরী, মান্না হক, সরকার ফিরোজ উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন।

স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে অনেক গান রচিত হয়েছে সেই সময়। হঠাৎ লেখা এবং সুর। আবার পরিস্থিতির প্রয়োজনে লেখা ও সুর। সেই সময়ে সুর করা শ্যামদার কিছু গান এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি, বাংলাদেশের নাম।’ এই গানের গীতিকার আবুল কাশেম সন্দীপ। ‘আয়রে চাষী মজুর কুলি’, গীতিকার কবি দেলওয়ার। বিশ^প্রিয় চট্টোপাধ্যায়ের কথায় ‘আজ রণ-সাজে বাজিয়ে বিষাণ’, ‘ওরে শোন রে তোরা শোন’ এবং ‘আহা ধন্য আমার জন্মভূমির পুণ্য সলিলে।’ আনোয়ার কবিরের কথায় ‘হাজার ভাইয়ের বিয়োগ ব্যথায়।’ সুব্রত সেনগুপ্তের কথায় ‘রক্ত চাই অত্যাচারীর রক্ত চাই।’ শহীদুল ইসলামের কথায় ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’ এবং ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই।’

‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’ গানটি বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেমিক এবং নতুন প্রজন্মের জন্য একটি উপযুক্ত গান। ‘আহা ধন্য আমার জন্মভূমির পুণ্য সলিলে’ গানটি শুনলে সুরের আবেগে চোখ ভিজে যায়! ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’ গানটিতে প্রচণ্ড উন্মাদনা জাগে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে শ্যামদার সর্বশেষ গান ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই।’ আবার এই গানটি নতুন, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গান।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকালে, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের ফ্লোরে বসে একটি গানের রিহার্সেল করছিলাম। দুপুর আড়াইটার দিকে খবর এলো পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় সারেন্ডার করেছে। দেশ স্বাধীন!! এবার নতুন গান, স্বাধীনতার গান লাগবে। শহীদুল ইসলাম ভাই একটু একটু করে লিখলেন ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই।’ শ্যামদা ওখানে বসে সুর করছেন, আমাদের তুলে দিচ্ছেন। ১৫ মিনিট থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে গান বানানো শেষ। শ্যামদা অজিতদাকে বললেন, দাদা, আপনাকে এই গানে লিড দিতে হবে। পরে আমরা সবাই মিলে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গানটি রেকর্ড করি!

শ্যামদার সুরে প্রচুর আধুনিক গান আছে। যারা তার সুর করা আধুনিক গান নিয়ে গবেষণা করেছেন, কণ্ঠ মিলিয়েছেন, গান তুলেছেন এবং রেকর্ড করেছেন, তারা নিশ্চয়ই বুঝবেন যে, শাস্ত্রীয়সংগীতে তার মেধা কত বিস্তৃত ছিল! কী অসম্ভব সুন্দর সুর এবং অর্কেস্ট্রেশন! শ্যামদার সুরে ’৯০-এর দশকে বাংলাদেশ বেতারে আমি বেশ কিছু গান করেছি। এর মধ্যে একটি দেশের গান করেছি আকরাম হোসেনের কথায় কথায় ‘সোনার মুকুট পরিয়ে, পক্ষীরাজে চড়িয়ে।’

শ্যামদা আমাকে ছোটবেলা থেকেই ভীষণ স্নেহ করতেন। ছোট ভাইয়ের মতো আদর করতেন। আমাকে আমার কাজে এবং আমার ওপর বরাবরই অজিতদা এবং শ্যামদা আস্থা রাখতেন। তাদের কখনও রিহার্সেলে আসতে দেরি হলে আমাকে ফোন করে বলতেন, ‘তিমির, তুই রিহার্সেলটা চালিয়ে নে, আমরা আসছি অথবা, আমি আসছি।’ আমরা গান নিয়ে বহুবার আলোচনা করেছি। স্বাধীনতা দিবস অথবা বিজয় দিবসের কোনো অনুষ্ঠান এলে আগে আমাকে ফোন দিয়ে পরামর্শ করতেন। কোন কোন চ্যানেলে কাকে সঙ্গে নিয়ে গাইতে হবে, তা বলে দিতেন। নিজের উপস্থাপনায় বহু অনুষ্ঠানে শ্যামদা আমাকে ডেকেছেন। আবার আমার সুর করা গানের খুব প্রশংসা করতেন। বলতেন, তোর নতুন গান হলে আমাকে পাঠাস, আমি শুনব। নিজের সুরে নিজের গান রেকর্ড করে যেমন পাঠিয়েছি, তেমনি আমার সুরে নতুন প্রজন্মের শিল্পীকে দিয়ে গাইয়ে পাঠিয়েছি। সুরের এবং নতুন প্রজন্মের শিল্পীর গান শুনে প্রশংসা করতেন। বলতেন, আমি জানি, তুই খুব ভালো সুর করিস। অমুক খুব ভালো গেয়েছে। এমন কারুকাজ করা সহজ নয়! মিউজিক কম্পোজিশন নিয়েও কথা হতো।

একবার চ্যানেল আই-এর ৭ম অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান হলো যমুনা নদীর তীরে। চ্যানেল আই থেকে আমরা সব শিল্পীরা বাসে রওনা দিলাম। বাসে বসেও শ্যামদার সঙ্গে গান নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমি আমার বন্ধু খোকন সিরাজুল ইসলামের কথায় এবং আমার সুরে গাওয়া ‘ঝর ঝর বারিধরা সন্ধ্যায়’ গানটি দাদাকে শুনতে দিলাম। কানের কাছে অডিওটা নিয়ে খুব মন দিয়ে শুনে বললেন, আবার দে। আবার প্লে করলাম। এভাবে দাদা, ৯ বার গানটি শুনলেন! শুনে বললেন ‘আমি তোকে ধন্যবাদ জানাই, ভাই, তুই এই সময়ে এমন গান করার সাহস করছিস!’ আসলে গানটি ছিল সেমি ক্ল্যাসিক্যাল। এখন তো এমন গান আর হয় না, চলে না!

দিনে দিনে এমন সব সংগীত নক্ষত্রদের হারিয়ে সংগীতাঙ্গন শূন্য হয়ে যাচ্ছে! একে একে অনেকেই চলে গেছেন। শ্যামদাও চলে গেলেন! আমরা অভিভাবকহীন হয়ে গেলাম! এই শূন্যতা কোনো কিছু দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। সুজেয় শ্যাম বাংলাদেশের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।