কী বাদ দিলে সংসার চলবে, চিন্তায় মানুষ
রাজধানীর কদমতলী এলাকার সাদ্দাম মার্কেটে সবজির বাজারে লাউ বাছাই করতে করতে বিক্রেতার কাছে দাম জানতে চাইলেন মোসাম্মত রাবেয়া আক্তার। কিন্তু প্রতি পিসের দাম ৯০ টাকা শুনেই ঝুড়িতে রেখে দিলেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘৬০ টাকার লাউ ৯০ টাকা! খাইলাম না লাউ।’ কথা হলে রাবেয়া বলেন, ‘তরিতরকারি যেইডা ধরি, হেইডার দামেই আগুন। শাকপাতাও কিনা খাইতে কষ্ট হইতাছে। এক আডি লাল শাক ৩০ টাকা। বাসাবাড়িত কাম কইরা যা কামাই, তা দিয়া এত দামে কেমনে কিনুম।’
কোনাপাড়া বাজারে লাউ, ঢেঁড়স, গাজর, পেঁপে, কাঁচামরিচ, ধনেপাতা ও লালশাক কিনতেই বেসরকারি চাকরিজীবী রিফাত মোসলেমের পকেট থেকে ৫০০ টাকার নোট উধাও। আক্ষেপ করে রিফাত বলেন, চালের দাম অত্যধিক বেড়েছে। গরু-খাসি-মাছ দূরে থাক, ব্রয়লার কিংবা ডিমও এখন হিসাব করে খেতে হচ্ছে। সাশ্রয়ী হতে তরিতরকারি খাব, তারও উপায় নেই।
বাজার খরচের অসহনীয় চাপে এভাবেই কষ্টে আছেন রাবেয়া ও রিফাতের মতো ভোক্তারা। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা, যেসব নিত্যপণ্যের ওপর নির্ভর করেন- গত এক বছরে সেসব পণ্যের পেছনে যেভাবে ব্যয় বেড়েছে, তাতে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনটা বাদ দিয়ে, কোনটা কম খেয়ে চলছে এখন সাধারণ মানুষের সংসার। অর্থাৎ প্রয়োজন হলেও কোন পণ্যটি বাদ দিয়ে সংসার চালানো যায়, এমন চিন্তা পেয়ে বসেছে মানুষকে।
গত এক বছরে মাঝারি ও মোটা চাল থেকে শুরু করে অ্যাঙ্কর ডাল, খোলা তেল, পেঁয়াজসহ প্রায় সব পণ্যের পেছনে খরচ বেড়েছে। অথচ বাজারে পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। হাতের কাছে রয়েছে সব কিছু, কিন্তু পকেটের নাগালের বাইরে রয়েছে বেশির ভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য।
বাজারের চিত্র বলছে, মধ্যবিত্তের চাল হিসেবে পরিচিত মাঝারি আটাশ চালের কেজি এখন ৬০ থেকে ৬২ টাকা। গত বছর এমন সময় যা ৫৪-৫৫ টাকা ছিল। নিম্নআয়ের মানুষের ভরসা মোটা চালের দামও এক বছরে কেজিপ্রতি ৫ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে। গত বছর ৫০ টাকায় বিক্রি হওয়া মোটা চাল এখন কিনতে হচ্ছে ৫৫ থেকে ৫৬ টাকায়।
চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বাজার অস্থির হতে শুরু করে। সে সময় বস্তায় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দাম বাড়ে। এরপর বন্যার কারণে দাম বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
কারওয়ান বাজারের চাল বিক্রেতা মো. মনিরুল ইসলাম জনি বলেন, দাম বাড়ার পেছনে যৌক্তিক কারণ রয়েছে। তবে যতটা বেড়েছে, সেটা অযৌক্তিক এবং অস্বাভাবিক। মূলত বড় মিলগুলো আগে বাড়িয়েছে, পরে অন্যরাও বাড়িয়েছে।
প্রতিদিনের রান্নায় দরকারি পণ্য পেঁয়াজের কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা কিনে খেতে হচ্ছে। গত বছর অক্টোবরে যা ছিল ৮৫ টাকা। এক সময়ের সস্তা পণ্য হিসাবে পরিচিত আলু এখন দামি পণ্যে পরিণত হয়েছে। গত বছর ৪২ টাকায় এক কেজি আলু কেনা গেছে। এখন তা ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়লে সবজির ওপর নির্ভরতা বাড়ে নিম্ন আয়ের মানুষের। অথচ সবজি কিনতেও এখন পকেট পুড়ছে। বাজারে বেশির ভাগ সবজি ১০০ টাকার আশপাশে বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর ৫০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে কেনা গেছে। সস্তা পেঁপের কেজি এখন ৫০ টাকা হয়েছে। বেগুন, করলা, বরবটি, ধুন্দল, ঝিঙে ও চিচিঙ্গা, টমেটো, কাঁকরোল, মুলা, লাউ, চালকুমড়া, কপি, টমেটো- এসব পণ্য এখন নিম্নবিত্তরা এড়িয়ে চলছেন। মধ্যবিত্তদেরও হিসাব করে কিনতে হচ্ছে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরজুড়ে নানা অজুহাতে দাম বেড়েছে। সংকটকালে যতটা না বাড়ার কথা, তারচেয়েও বেশি বেড়েছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
বাজার বিশ্লেষক ও ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বর্তমান সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু বাজারে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণেও নজর দিতে হবে। এখানে একটি সমস্যা হচ্ছে চাঁদাবাজি। এটি বন্ধ হলে দাম ১৫ শতাংশ কমে আসবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দাম বেঁধে বা অভিযান চালিয়ে নিয়ন্ত্রণ হবে না। পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি দরকার। উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে হাত বদলের সংখ্যা কমাতে হবে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) গবেষণায়ও উঠে এসেছে- হাত বদলের মধ্য দিয়ে পণ্যের দাম বাড়ছে। এ ছাড়া অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, কৃত্রিম সংকট, এলসি খোলার সমস্যা, টাকার অবমূল্যায়ন, কম সরবরাহ, অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা, উচ্চ পরিবহন খরচ, বাজারের আধিপত্য ও সীমিত দর কষাকষির ক্ষমতা।
ক্যাবের সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, কোনো পণ্যের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিলে তার সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। যেমনটা সম্প্রতি ডিমের ক্ষেত্রে দেখেছি। সুযোগ পেলেই সংকট তৈরি করা হয় এবং যে যেভাবে পারে দাম বাড়ায়।
অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তি নিশ্চিতের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের আইন আছে, প্রয়োগ নেই। অতীতে কারসাজিকারীদের চিহ্নিত করার পরও শাস্তি দেখিনি। সেখানে রাজনৈতিক পরিচয় গুরুত্ব পেয়েছে। তাই বিচার হয়নি, কারসাজিও বন্ধ হয়নি।
স্বল্প আয়ের প্রোটিনের সহজলভ্য উৎস হিসেবে পরিচিত ব্রয়লার মুরগি ও ফার্মের ডিম গত এক বছরে নাগালের বাইরে চলে গেছে। বন্যার অজুহাতে দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। কিছুদিন আগে ডিমের ডজন ১৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এখন ১৬০ টাকায় নেমে এলেও তা নিম্নবিত্তের সামর্থ্যরে বাইরে। অপরদিকে ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকা। গত বছর এমন সময় যা ছিল ১৮০ টাকার আশপাশে।
স্বল্প আয়ের মানুষের বাজার তালিকায় আরও রয়েছে অ্যাঙ্কর ডাল ও খোলা পাম তেল। এক বছরে পণ্য দুটিতে খরচ বেড়েছে যথাক্রমে ১০ টাকা এবং ২০ টাকা।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এসব পণ্যের মধ্যে গত এক বছরে আলুর দাম বেশি বেড়েছে। পণ্যটির দাম ৩২ দশমিক ১৮ শতাংশ বেড়েছে। এরপর পেঁয়াজের দাম ২৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেড়েছে। পাম তেলে বেড়েছে ১৪ দশমিক ১২ শতাংশ, আর অ্যাঙ্কর ডালে খরচ বেড়েছে ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এক বছরে মাঝারি চালে ১০ দশমিক ৪৮ শতাংশ এবং মোট চালের মূল্যবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া ব্রয়লার মুরগির মূল্যবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।