আসামে যাওয়া শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে জটিলতা
নাগরিকত্ব আইনে আসামের জন্য যে বিশেষ ধারা তৈরি করা হয়েছিল ১৯৮৫ সালে, তা বহাল রাখলো সুপ্রিম কোর্ট। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, একাত্তরের পরে যারা এসেছেন, তারাও নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে যে নিয়ম ছিল, সে নিয়মই বহাল রেখেছে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। আইনে আসামকেন্দ্রিক যে অনুচ্ছেদটি বাতিলের দাবি করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে, আদালত তা খারিজ করে দিয়েছে।
ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ অনুযায়ী দেশভাগের পর যারা পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের মধ্যে ভারতে প্রবেশ করেছেন উদ্বাস্তু বা শরণার্থী হিসেবে, তারা ভারতীয় নাগরিক। আলাদা করে তাদের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে না। ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনের ছয় নম্বর ধারায় এই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল।
১৯৮৫ সালে এই আইনের সংশোধন ঘটিয়ে আসামের জন্য একটি আলাদা অনুচ্ছেদ তৈরি করা হয়। যা ৬এ ধারা নামে যা পরিচিত। এই সংশোধনে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে উদ্বাস্তু বা শরণার্থী ভারতের আসাম রাজ্যে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের মধ্যে প্রবেশ করেছেন, তারা ভারতীয় হিসেবে গণ্য হবেন। আসাম রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক বিতর্কের পর কেন্দ্র এবং আসাম সরকারের মধ্যে আসাম চুক্তি হয়েছিল। যেখানে সারা আসাম ছাত্র সংগঠন বা আসু অন্যতম পার্টি ছিল। সেই চুক্তির ভিত্তিতেই নাগরিকত্ব আইনে আসামকেন্দ্রিক এই সংশোধন করা হয়েছিল
আরও পড়ুন:
রোগীর পেটে জীবন্ত মাছি!
২০১২ সালে আসাম সম্মিলিত মহাসংঘ নামে একটি প্রতিষ্ঠান নাগরিকত্ব আইনের ৬এ ধারাটিকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে। এই সংগঠনের পাশাপাশি আরো বেশ কিছু গোষ্ঠী এই বিষয়ে মামলা করেছিল আদালতে। সুপ্রিম কোর্ট পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ সবকটি মামলা একত্র করে শুনানির নির্দেশ দেয়। পাঁচ বিচারপতির এই বেঞ্চের নেতৃত্বে ছিলেন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়।
আসাম সম্মিলিত মহাসংঘের দাবি ছিল, ১৯৮৫ সালের সংশোধনে যে ৬এ অনুচ্ছেদটি যুক্ত করা হয়েছে শুধুমাত্র আসাম রাজ্যের জন্য, তা অসাংবিধানিক। তাদের অভিযোগ, অনুচ্ছেদটি বৈষম্যমূলক এবং বেআইনি। তাদের দাবি ছিল, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসামে আসা উদ্বাস্তু এবং শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে কাট অফ ডেট ১৯৭১ সালের পরিবর্তে ১৯৫১ করতে হবে। কারণ, ওই বছরই আসামে নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি হয়েছিল। যার সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। তাদের দাবি, যেহেতু বাকি দেশে পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তু এবং শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সময়সীমা ১৯৪৮, ফলে আসামের ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যতিক্রম হওয়া উচিত নয়। এনআরসি হওয়ার কারণে তারা ১৯৫১ সালের কাট অফ ডেটের দাবি তুলেছিল।
২০১৪ সালে এই আবেদন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে প্রথম শুনানি হয়। প্রায় ১০ বছর ধরে এই শুনানি চলেছে। এই সময়ের মধ্যেই ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৮ সালে এই একই বিষয়ে আরও সাতটি মামলা সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হয়। সেই মামলাগুলিকেও এই মামলায় যুক্ত করা হয়। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ২০১৪ সালেই সাংবিধানিক বেঞ্চ তৈরি করে মামলাটির বিচার শুরু হয়।
মামলা চলাকালীনই আসামে আবার নাগরিকপঞ্জির নবিকরণ করা হয়। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এই কাজ চলে। ১৯ লাখ মানুষের নাম নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়ে।
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস
১০ বছর ধরে শুনানি চলার পর গতকাল বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতি তাদের রায় ঘোষণা করে। পাঁচজনের মধ্যে এক বিচারপতি মামলাকারীদের বক্তব্যকে সমর্থন জানালেও বাকি চার বিচারপতি পুরনো আইন বৈধ বলে ঘোষণা করেন। ফলে, মামলাকারীদের দাবি খারিজ হয়ে যায়।
প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘আসাম চুক্তি বা আসাম অ্যাকর্ডের মাধ্যমে অবৈধ অভিবাসন সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। ওই একই সমস্যার আইনি সমাধান হলো ৬এ ধারাটি।’ জনগণের সুরক্ষা এবং মানবিক উদ্বেগের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করা হয়েছিল ওই ধারাটি তৈরি করে।
মামলাকারীদের প্রশ্ন ছিল, ভারত-বাংলাদেশের মোট সীমান্ত চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। তার মধ্যে সব চেয়ে বড় সীমান্ত পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। সেখানেও পূর্ব পাকিস্তান এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু এবং শরণার্থীরা ঢুকেছেন। তাহলে আসামের ক্ষেত্রে আলাদা করে এই ধারা তৈরি হবে কেন?
জবাবে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, নথি অনুযায়ী আসাম রাজ্যের আয়তনের অনুপাতে শরণার্থী অনুপ্রবেশের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সংখ্যাটি ৪০ লাখেরও বেশি। পশ্চিমবঙ্গে নথিভুক্ত শরণার্থীর সংখ্যা ৫৭ লাখ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের আয়তনও অনেক বড়।
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস