যে আক্ষেপ নিয়ে চলে গেলেন একাত্তরের কণ্ঠসৈনিক সুজেয় শ্যাম

সোহাগ আশরাফ
১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৩২
শেয়ার :
যে আক্ষেপ নিয়ে চলে গেলেন একাত্তরের কণ্ঠসৈনিক সুজেয় শ্যাম

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সংগীত পরিচালক ও সুরকার সুজেয় শ্যামের শারীরিক অবস্থা বেশ কিছুদিন ধরেই ছিল সংকটাপন্ন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সুরকারের চিকিৎসা চললেও তার জন্য আইসিইউ শয্যা মিলছিল না বলে জানিয়েছিলেন মেয়ে রূপমঞ্জুরী শ্যাম লিজা।

অবশেষে বৃহস্পতিবার দিনগত রাত ২টা ৫০ মিনিটের দিকে তার মৃত্যু হয়েছে।

যদিও কয়েক বছর ধরেই শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে কাটছিল সুজেয় শ্যামের দিন। গত জুন মাসেও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন এই সংগীতব্যক্তিত্ব। ক্যান্সার, ডায়েবেটিস, কিডনিসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। গত সেপ্টেম্বরে তার হার্টে পেসমেকার বসানোর পর ইনফেকশন হয়ে যায়।

সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইসিইউতে শয্যা খালি না থাকায় তাকে সিসিইউতে চিকিৎসা দেওয়া হয় বলে জানান মেয়ে লিজা। সে সময় তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা আইসিইউ বেড পাওয়ার জন্য সবাই মিলে চেষ্টা করছি। এই হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি নেই। বেড ম্যানেজ হলে আইসিইউতে নেওয়া হবে। সবাই দোয়া করবেন।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের গানের কথায়-সুরে মুক্তিকামী মানুষেরা হতেন উদ্দীপ্ত, তাদের একজন ছিলেন একাত্তরের কণ্ঠসৈনিক সুজেয় শ্যাম। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই সুরকারের ‘আক্ষেপ’ ছিল অনেক। গণমাধ্যমকে এ নিয়ে কথাও বলেছিলেন তিনি।

তার আক্ষেপের অন্যতম একটি ছিল, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের সরকারি অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রণ পাননি।

গতবছর ২৩ জুলাই ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী আয়োজিত ‘কথা-গানে ফকির আলমগীরকে স্মরণ’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন সুজেয় শ্যাম। অনুষ্ঠানে তাকে ‘ফকির আলমগীর স্মৃতিপদক’ দিয়ে সম্মান জানানো হয়।

পদকপ্রাপ্তির অনুভূতি জানাতে গিয়ে সুজেয় শ্যাম তখন বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মত মহামানবের জন্মশতবর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠানে আমাকে দাওয়াত করা হয় নাই। যে কদিন বেঁচে আছি, দেশকে যেন ভালোবাসতে পারি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সঙ্গে নিয়ে চলতে পারি।’

অনুষ্ঠানের পর গণমাধ্যমকে সুজেয় শ্যাম একই ‘আক্ষেপ’ করে বলেন, ‘এখন আমাদের আর কেউ খবর নেয় না। বিটিভি এবং বাংলাদেশ বেতার থেকে মাঝে মাঝে আমাকে ডাকে কাজ করার জন্য। আর কোনো টেলিভিশন আমাকে ডাকে না। আগে বিভিন্ন দিবসে যেমন ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর এলে আমরা সময় পেতাম না। সব টিভি চ্যানেল ডাকত। এখন কেউ ডাকে না।’

এমন নানান অভিযোগ আর আক্ষেপ ছিল তার।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নয়টি গানে সুর করেছিলেন সুজেয় শ্যাম, যেগুলো একাত্তরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গাওয়া হয়েছিল।

এর মধ্যে রয়েছে ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’, ‘ওরে শোনরে তোরা শোন’, ‘রক্ত চাই রক্ত চাই’, ‘আজ রণ সাজে বাজিয়ে বিষাণ’, ‘আহা ধন্য আমার’,‘আয়রে চাষী মজুর কুলী’।

তার সুর করা গানের মধ্যে ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’ এবং ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ গান দুটি বাংলাদেশের যে কোনো জাতীয় দিবসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখনই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার ও সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যামকে বলা হল, বিজয়ের গান করতে।

এরপর শহীদুল ইসলামের লেখা ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই/ খুশির হাওয়ায় উড়ছে/ উড়ছে উড়ছে উড়ছে/ বাংলার ঘরে ঘরে’ গানটিতে সুর করেন সুজেয় শ্যাম।

মাত্র ১৫ মিনিট লেগেছিল গানটি লেখা ও সুর করতে; এরপর রেকর্ডিং। আর পুরো গানটার জন্ম হয়েছিল মাত্র এক ঘণ্টায়।

গিটার বাদক ও শিশুতোষ গানের পরিচালক হিসেবে ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান চট্টগ্রাম বেতারে কর্মজীবন শুরু হয় সুজেয় শ্যামের। পরে তিনি ঢাকা বেতারে যোগ দেন।

১৯৬৯ সালে চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন সুজেয় শ্যাম। ঢাকাই চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য তিনবার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।

বাংলাদেশ বেতারের প্রধান সংগীত প্রযোজক পদ থেকে ২০০১ সালে অবসরে যান সুজেয় শ্যাম।

২০০৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত ৪৬টি গানের সংকলন নিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের গান’ শিরোনামে একটি অ্যালবামের সংগীত পরিচালনা করেন তিনি।

এর ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে আরও ৫০টি গানের সংকলন নিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের গান-২’ নামে আরেকটি অ্যালবামের সংগীত পরিচালনা করেন শিল্পী। ‘টুনাটুনি অডিও’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সংগীত পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।

১৯৪৬ সালে সিলেটে জন্ম নেওয়া সুজেয় শ্যামকে সংগীতে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে একুশে পদক দেওয়া হয়। তার আগে ২০১৫ সালে শিল্পকলা পদক পান তিনি।