পদ্মা সেতুসহ মেগা প্রকল্পের ব্যয় পর্যালোচনায় সরকার

আবু আলী
১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
পদ্মা সেতুসহ মেগা প্রকল্পের ব্যয় পর্যালোচনায় সরকার


ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ থেকে পলাতক শেখ হাসিনার আমলে নেওয়া পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সব মেগা প্রকল্পের ব্যয় পুনর্মূল্যায়ন শুরু করেছে সরকার। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয়, বৈদেশিক ঋণ, এখন পর্যন্ত খরচ পর্যালোচনা করবে সরকার। একই সঙ্গে এসব প্রকল্পের ব্যয়ের যৌক্তিকতাও দেখা হবে। ইতোমধ্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ সংক্রান্ত বৈঠকও করেছেন। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, যেসব প্রকল্প অতি মূল্যায়িত হয়েছে, সেগুলোর কারণ খুঁজে বের করা হবে। এক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় বিধিমালা (পিপিআর) সঠিকভাবে মানা হয়েছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখা হবে। কেউ পিপিআর লঙ্ঘন করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে

নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কিংবা ঠিকাদারি কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। এ ছাড়া কোনো কর্মকর্তা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এমন প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, আগের সরকারের নেওয়া প্রকল্পগুলো অবশ্যই পর্যালোচনা করা দরকার। তবে সেটি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পর্যালোচনা করতে হবে। বড় বাজেটের প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ সব প্রকল্পের পর্যালোচনা সম্ভব নয়। এ ছাড়াও সড়কে যেসব অগ্রাধিকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেগুলোর চুক্তি কিভাবে করা হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। এসব প্রকল্পে বিপুল অর্থ খরচ হয়ে গেছে।

জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো শেখ হাসিনা সরকারের নেওয়া সাতটি মেগা প্রকল্প চলমান আছে। এসব প্রকল্পে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। এর মধ্যে একমাত্র রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ছাড়া বাকি ছয়টি প্রকল্পের ৯০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। তবে বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয়ে এ রকম প্রকল্প নেওয়ার কী প্রয়োজনীয়তা ছিল এবং প্রকল্পগুলো যৌক্তিকভাবে নেওয়া হয়েছে কিনা, এসব পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, প্রকল্পগুলোর ব্যয় পর্যালোচনার কাজটি করছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকার দেশের অর্থনীতির ওপর যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে, সেখানেও মেগা প্রকল্পের ওপর একটি পর্যালোচনা থাকবে। তাতে প্রকল্পগুলোর আদৌ দরকার ছিল কিনা; কেন নেওয়া হয়েছিল-এসব খোঁজা হচ্ছে। পাশাপাশি খরচও পর্যালোচনা করা হবে।

জানা গেছে, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার সরকার মেগা প্রকল্পের নামে বেশ কিছু প্রকল্প রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল বলে আলোচনা আছে। আবার বেশি অর্থব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। নতুন সরকার এখন এসব প্রকল্পের অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা খুঁজছে। প্রাথমিকভাবে আইএমইডি কাজ শুরু করেছে।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পের তালিকায় আটটি প্রকল্প ছিল। গত জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। ২২ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প শেষ হয় ৩২ হাজার কোটি টাকায়। পুরো অর্থই জনগণের করের টাকা থেকে জোগান দেওয়া হয়েছে।

২০১২ সালে রাজধানীর উত্তরা থেকে মিরপুর ও ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু করা হয়েছে। এখন চলছে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেলের সম্প্রসারণের কাজ। মোট প্রকল্প ব্যয় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। জুলাই পর্যন্ত বাস্তবায়ন হার ভৌত অগ্রগতি ৯০ শতাংশ। এই প্রকল্পে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে জাপানের জাইকা। শুধু টিকিট বিক্রির টাকায় এই ঋণ শোধ করতে ৪৫ বছর সময় লাগবে।

বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বিনিয়োগে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ গত জুলাই মাস পর্যন্ত প্রায় ৯৯ শতাংশ শেষ হয়েছে। ১৬ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে ইতোমধ্যে একটি ইউনিটে উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে এতে পরিবেশ বিনষ্ট হয়ে সুন্দরবনের ক্ষতি হতে পারে- এমন অভিযোগ শুরু থেকেই ছিল।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ গড়ে তুলতে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের কাজ ৯৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। ট্রেন চলাচল শুরু করেছে। দিনে ৪৮টি ট্রেন চলার কথা; কিন্তু চলে মাত্র ১০টি।

রাশিয়ার ঋণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এটি শেষ হওয়ার কথা। গত জুলাই মাস পর্যন্ত প্রকল্পের মাত্র ৬৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। এ প্রকল্পের অন্যতম দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, ২০২৭ সালের শুরু থেকে বছরে প্রায় ৫০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্রগতি হয়েছে ৮৮ শতাংশ। ২০২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ হবে।

পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পটি দুইবার সংশোধনের পর খরচ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত ৯৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। জানা গেছে, মোংলা বন্দর থাকা সত্ত্বেও ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে পায়রা বন্দর নির্মাণের উদ্দেশ্য, শুধুই রাজনৈতিক। নিয়মিত ড্রেজিং করা না হলে বন্দরটি কার্যকর করা কঠিন।

চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৯৯ শতাংশ। এই পথে ট্রেন চলাচল শুরু করেছে। তবে আপাতত মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে না। দিনে ২৬টি ট্রেন চলাচলের কথা থাকলেও চলছে মাত্র ৬টি।