রাজনৈতিক লেজুড়মুক্তি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ
১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রচালনায় ছিল শেখ হাসিনা সরকার। এ সময়কালে বিচার, পুলিশ, প্রশাসন, আর্থিক খাতসহ রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই চরম রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের সার্বিক সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশন গঠনের পর সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জেগেছে, জনপ্রশাসনে কেমন সংস্কার প্রত্যাশিত? এ প্রশ্নে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বপ্রথম ও প্রধানত গুরুত্বারোপ করতে হবে রাজনীতিকরণ থেকে প্রশাসনকে মুক্ত করায়। প্রশাসন চলবে রাষ্ট্রের কল্যাণের লক্ষ্যে, দলীয় উদ্দেশ্য হাসিল কিংবা ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় নয়। এ ছাড়া আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করতে হবে; পদায়ন, পদোন্নতিতে থাকতে হবে সুস্পষ্ট নীতি এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে তা অনুসরণ করতে হবে। সরকারি দপ্তরগুলোয় টেকনিক্যাল ননটেকনিক্যাল পদভেদে বদলির মেয়াদ ভিন্ন নির্ধারণ করতে হবে। কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণলব্দ জ্ঞান প্রয়োগের অবারিত সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি বিসিএস ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষায়ও পরিবর্তন আনা জরুরি।
জনপ্রশাসনে পদোন্নতি-পদায়নে সরকারদলীয় রাজনীতিকদের লিখিত সুপারিশ যাকে বলা হয় আধা সরকারি পত্র বা ডিও লেটার এবং অলিখিত (ফোন বা মৌখিক) তদবিরের অপচর্চা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এ কারণে অনেক কর্মকর্তা যোগ্য ও মেধাক্রমের শীর্ষে থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত হয়েছেন পদোন্নতি থেকে। রাজনৈতিক পরিচয়ে কিংবা লেজুড়বৃত্তির ভিত্তিতে সুপারিশের মাধ্যমে মেধাক্রমে পিছিয়ে থেকেও পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন অনেকে। এমন নজিরের শেষ নেই। যদিও পদোন্নতির ক্ষেত্রে ডিও লেটার প্রদানের বিষয়টি সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপীল) বিধিমালা-১৯৮৫ এর পরিপন্থি। কিন্তু প্রশাসনে রাজনৈতিক নেতাদের বিস্তর প্রভাবের জেরে দীর্ঘদিন ধরে এ বিধি উপেক্ষিতই থেকে গেছে। এ কারণে পদোন্নতি-পদায়নে ইচ্ছুক কর্মকর্তারাও নিজেকে কত বেশি দলীয় আনুগত্যশীল, তা প্রমাণে ছিলেন যারপরনাই ব্যস্ত। গেল আওয়ামী লীগ শাসনামলে যারা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের একান্ত সচিব ছিলেন, দেখা গেছে, তাদের সহজেই পদোন্নতি হতো। এমন কর্মকর্তারা প্রাইজপোস্টিং হিসেবে জেলা প্রশাসকের পদও বাগিয়ে নেন। সে সময় সচিব হতে চাইলে রাজনৈতিক নেতাদের ডিও লেটার ‘ম্যানেজ’ করাটা ছিল খুবই চর্চিত বিষয়।
গত বছর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি ডিও লেটার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়Ñ অনেক কর্মকর্তাকে ‘সৎ’ ‘যোগ্য’ প্রভৃতি তকমাযুক্ত ডিও লেটার দেওয়া হয়। আবার কর্মকর্তাদের অতীত রাজনৈতিক-সম্পৃক্ততার বিষয়টি যুক্ত করেও প্রত্যয়ন করতে দেখা গেছে কাক্সিক্ষত পদোন্নতি বা পদায়নের লক্ষ্যে। যেমনÑ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কামরুন নাহারকে গ্রেড-১ পদোন্নতি দিতে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক ডিও দেন। মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের একটি প্রকল্পের পরিচালক (উপসচিব) মো. নুরুল আমিনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দিতে এবং মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম মাহাবুবুর রহমানকে সচিব পদে পদোন্নতির জন্য ডিও দিয়েছিলেন এই মন্ত্রী। সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ডিও দিয়েছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাইফুল ইসলামকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দিতে। তিনি উল্লেখ করেন, সাইফুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মোমিনুর রশীদকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দিতে ডিও দেন সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুল আখেরকে উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দিতে ডিও দেন সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ রেজাউল করিমকে গ্রেড-১-এ পদোন্নতি দিতে ডিও দেন সাবেক তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রঞ্জিত কুমার দাসকে গ্রেড-১-এ পদোন্নতি দিতে ডিও দেন সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মনিরুজ্জামানকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির ডিও লেটার দেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার।
জনপ্রশাসনের সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে একজন কর্মকর্তার অতিরিক্ত সচিব
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
পদে দুই বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন (এসিআর), গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন, রাজনৈতিক মতাদর্শ, চাকরিজীবনের সুনাম, দক্ষতা ও যোগ্যতা বিবেচনায় নেওয়া হয়। যুগ্ম সচিব পদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের শর্ত পূরণের পর পদোন্নতি পাওয়ার কথা কর্মকর্তাদের। কিন্তু রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণে তদবির বেড়ে গেছে। এখন দেখা হয়Ñ কে কার লোক। সেই বিবেচনায় পদোন্নতি দেওয়া হয়। এতে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। শতভাগ নিয়ম মেনে পদোন্নতি দিলে ডিও লেটারের বিধিবহির্ভূত চর্চা আর থাকবে না।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণ থেকে মুক্ত করা প্রসঙ্গে সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আইয়ুবুর রহমান খান আমাদের সময়কে বলেন, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালায় বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মচারী তার পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য কোনো অনুরোধ বা প্রস্তাব নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো সংসদ সদস্য বা অন্য কোনো বেসরকারি ব্যক্তির দ্বারস্থ হতে পারবেন না। এসব এড়াতে হলে সংস্কারের প্রথমেই প্রশাসনকে রাজনীতিকরণমুক্ত করতে হবে। জনপ্রশাসনে বৈষম্য দূর করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি। বলেন, সকল ক্যাডারে পদোন্নতিতে সমতা আনতে হবে। একটি ক্যাডারে গ্রেড-১ পদ ১০টি। আবার কোনো ক্যাডারে এ গ্রেড-১ পদ একটি বা দুটি। এসব ক্ষেত্রে সকল ক্যাডারে গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ পদ বাড়াতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জনপ্রশাসন সংস্কারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. ফেরদৌস আরফিনা ওসমান আমাদের সময়কে বলেন, সরকার যাদের জনপ্রশাসন সংস্কারের দায়িত্ব দিয়েছেন, তারা নিশ্চয় এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবেন। প্রশাসনকে রাজনীতির বৃত্ত থেকে মুক্ত করতে হবে। এ জন্য নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়নে সুস্পষ্ট নীতি থাকা উচিত এবং স্বচ্ছতার সঙ্গেই তা অনুসরণ করতে হবে। তিনি বলেন, কোন কর্মকর্তার কোথায় পদায়ন হবে? কেন হবে? কোন পদে কতদিন পর্যন্ত থাকতে হবে? বিশেষ করে টেকনিক্যাল ননটেকনিক্যাল পদের বদলি তিন বছর না হয়ে আরও বাড়ানো উচিত। কারণ একটা টেকনিক্যাল পদে পদায়ন হওয়ার দুই বছর পর ওই কর্মকর্তাকে যদি বদলি করা হয়, তাহলে ওখানে ফের নতুন কর্মকর্তা আসেন। এই সংশ্লিষ্ট বিষয় বুঝতে বুঝতে দুই বছর চলে যায়। আবার তাকে সরিয়ে দিলে সরকারের প্রকল্পের অগ্রগতি হয় না। মেয়াদ বেড়ে যায়, খরচ বাড়ে। এসব ক্ষেত্রে একজন কর্মকর্তাকে যথেষ্ট সময় দেয়া উচিত।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
অধ্যাপক ড. ফেরদৌস আরফিনা ওসমান যোগ করেন, ক্ষেত্রবিশেষে দেখা গেছে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান প্রয়োগের সুযোগ পান না অনেক কর্মকর্তা। দেখা গেছে, একজন কর্মকর্তা বিশেষায়িত বিষয়ে বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বিদেশে। এই কর্মকর্তা দেশে ফিরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে বদলি করে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে সরকার যে তার প্রশিক্ষণের জন্য বিনিয়োগ করছে, ওই জ্ঞান প্রয়োগের সুযোগ পেল না। এমনটা পরিহার করতে হবে।
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করা দরকার : শুধু একটি বিশেষ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, পদায়ন হবে। আর বাকি ক্যাডারদের ক্ষেত্রে শূন্যপদ থাকা সাপেক্ষ যুক্তি দেওয়া হয়। এটি বৈষম্য বাড়িয়ে দেয় বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।
প্রশাসনে প্রবেশের ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রয়োজন উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. ফেরদৌস আরফিনা বলেন, জনপ্রশাসনে বড় বিষয় হচ্ছে নিয়োগ। এক্ষেত্রে বিসিএস পরীক্ষার প্যাটার্ন, প্রশ্নের ধরন পরিবর্তন করা দরকার। বিদ্যমান প্রশ্নের উত্তরে উপযুক্ত প্রার্থী তুলে আনা যাচ্ছে না। প্রার্থীদের দক্ষতা উৎপাদনশীলতা নিরূপণ করা যায় না। প্রশ্নের ধরন হওয়া উচিত- যে একজন চাকরিপ্রার্থীর প্রবলেম সলভ করার অ্যাবিলিটি আছে কী না? ক্রিটিক্যাল থিংকিং কেমন, অ্যানালাইসিস করার যোগ্যতা কতটুকু। অথচ এখন ছেলেমেয়েরা পরীক্ষার জন্য ষষ্ঠ শ্রেণি-অষ্টম শ্রেণির গণিত আর কমন কিছু বিষয় পড়ছে। সে বিশ^বিদ্যালয়ের পড়ালেখাও করছে না। এদের চাকরিপ্রত্যাশার লেখাপড়া সরকারি চাকরিতে কোনো কাজে লাগেনা। বিসিএস পাস করার জন্যই সে ওসব পড়ে।
উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে। এ কমিশনে সদস্য হিসেবে আছেন সাবেক সচিব মোহাম্মদ তারেক ও মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. হাফিজুর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব রিজওয়ান খায়ের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এ ফিরোজ আহমেদ ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি।