অভিবাসী শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা গন্তব্য দেশ থেকেই শুরু করতে হবে
অভিবাসী শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা গন্তব্য দেশ থেকেই শুরু করতে হবে বলে একটি গবেষণায় উঠে এসেছে। মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সহায়তার কার্যকারিতা নির্ণয়ের অংশ হিসেবে সুইজারল্যান্ডের অর্থায়ণে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের ‘রিইন্টিগ্রেশন অব মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের অধীনে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এই গবেষণার মাধ্যমে বিদেশ-ফেরত অভিবাসী শ্রমিকদের জীবনে মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সেবার গুরুত্ব চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকরা নিজ দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় থেকেই নানা ধরনের মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হন। গন্তব্য দেশটিতে পৌঁছে তাদের বিচিত্র যেসব সংকটের মোকাবিলা করতে হয় তা তাদের মানসিক অবস্থাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। বিশেষ করে তারা যখন হঠাৎ নিজ দেশে ফিরে আসেন তখন পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়। এছাড়া বাংলাদেশে ফেরত আসা অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকাংশই দেশে ফিরে বেকারত্বের সম্মুখীন হন। এই বেকারত্বের চাপ তাদেরকে আর্থিক সংকট ও অন্যান্য সামাজিক বৈষম্যের মুখোমুখি করে। ক্রমশ বেড়ে চলা অর্থনৈতিক সংকট এবং মানসিক সমস্যার কারণে বিদেশ-ফেরতদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতা ঝুঁকির মুখে পড়ে।
এই প্রেক্ষাপটে, মূলধারার সমাজের সঙ্গে সফল পুনরেকত্রীকরণে তাদের নানামাত্রিক সহায়তার প্রয়োজন হয়। অভিবাসীদের সফলভাবে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম জরুরি সহায়তা, মনোসামাজিক সেবা ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে আসছে। ব্র্যাক এবং অন্যান্য কিছু সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে বিদেশ-ফেরতদের মনোসামাজিক সহায়তা প্রদান করলেও এ বিষয়ে অদ্যাবধি গবেষণা হয়নি বললেই চলে।
গবেষণার উদ্দেশ্য
এই গবেষণার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে রয়েছে বিদেশ-ফেরতদের সমাজের মূলধারায় পুনরেকত্রীকরণের জন্য মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সেবার প্রয়োজনীয়তা অনুসন্ধান, সমাজে পুনরায় একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে মানসিক ও সামাজিকভাবে বিদেশ-ফেরতরা যে যে প্রতিবন্ধকতার শিকার হন তা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্ণিত করা এবং তা থেকে উত্তরণে সম্ভাব্য সুযোগগুলো খুঁজে বের করা। ফেরত আসা ব্যক্তিদের মনোসামাজিক পরিস্থিতির উত্তরণে উপযুক্ত পদ্ধতি ও টুলস নির্বাচন করে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া এবং আরও উন্নত কৌশল ও প্রকল্প বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রদান করাো এই গবেষণার অন্যতম লক্ষ্য।
গবেষণার পদ্ধতি
গবেষণাটি পরিচালনার ক্ষেত্রে উদঘাটনমূলক পদ্ধতি (explanatory sequential design) ব্যবহার করা হয়েছে। এই গবেষণাটির ক্ষেত্রে পরিমাণগত (quantitative) এবং গুণগত (qualitative) উভয় পদ্ধতিই অনুসৃত হয়েছে। পরিমাণগত অংশে প্রাক ও পরবর্তী মূল্যায়ণ নকশা ব্যবহার করে ২০৫ জন বিদেশ-ফেরত অভিবাসীর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ডব্লিউএইচও-৫-এর ওয়েল-বিয়িং ইনডেক্স ব্যবহৃত হয়েছে। পরিমাণগত অংশে পাঁচটি ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন (FGD) এবং বিদেশ-ফেরত ব্যক্তিদের, তাদের পরিবারের সদস্যদের এবং মূল তথ্যদাতাদের সঙ্গে সাতটি বিস্তারিত সাক্ষাৎকার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
প্রধান ফলাফল
বিভিন্ন কারণ, যেমন বিদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনা, দেশে ফিরে আসার পরের পরিস্থিতি, এবং বিদেশ-ফেরতদের বিষয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তাদের জীবনে বহুমাত্রিক মানসিক সমস্যা সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে।
বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর, ফেরত আসা ব্যক্তিরা আর্থিক সংকট, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কে দ্বন্দ্ব, বিচ্ছেদ এবং তালাকের মতো ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছেন।
মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা সেবা (পিএসএস) বিদেশ-ফেরতদের জীবনে মানসিক সমস্যার তীব্রতা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে। এছাড়াও দেখা গেছে, গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নারীরা মানসিক সহায়তা পাওয়ার পর পুরুষদের থেকে ভালো ফল পেয়েছেন।
গবেষণায় বিদেশ-ফেরতদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যে সাদৃশ্যপূর্ণ লক্ষ্মণগুলো পাওয়া গেছে তা হল: বিরক্তি, অসহায়ত্ব, ট্রমা, আত্মঘাতী আচরণ, ঘুমের সমস্যা, রাগ, বিধ্বস্ত অনুভূতি, মন খারাপ, মনের মধ্যে ফাঁকা অনুভূতি হওয়া, মানসিক চাপ, হতাশা, উদ্বেগ, অপরাধবোধ, আবেগ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা, নেতিবাচক মন্তব্যের ভয় এবং মানুষের প্রতি অবিশ্বাস।
গবেষণায় পাওয়া গেছে যে, মনোসামাজিক সহায়তা পাওয়ার পরে বিদেশ-ফেরতরা নিজেদের মানসিক স্থিতি রক্ষা করতে নিজস্ব কৌশল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে: আত্মপ্রেরণার মাধ্যমে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া, নেতিবাচক মন্তব্য উপেক্ষা করা, জীবনসঙ্গীর ওপর নির্ভর করা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা, দৈনন্দিন কাজে সক্রিয় থাকা, পরিবারের মন্তব্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া, প্রতিবন্ধকতাগুলো মেনে নেওয়া এবং কষ্টদায়ক স্মৃতিগুলো পুনরায় মনে না করা।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে কাউন্সেলিং সেবা প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ বা সুবিধা অনুপস্থিত অথবা অপর্যাপ্ত। এছাড়াও, দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর অভাব এবং বিশেষত বিদেশ-ফেরত/অভিবাসী শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর পর্যাপ্ত গবেষণা না থাকার কারণে পিএসএস (পিএসএস) কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে।
প্রাক ও পরবর্তী মানসিক সহায়তা কার্যক্রমের জন্য ডব্লিউএইচও-৫-এর ওয়েল-বিয়িং ইনডেক্স প্রয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রধান সুপারিশসমূহ
অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা বিষয়ক এডভোকেসি গন্তব্য দেশ থেকেই শুরু করতে হবে।
সরকারের পুনরেকত্রীকরণ নীতিতে ফেরত আসা অভিবাসী শ্রমিক এবং পাচার হওয়া ব্যক্তিদের জন্য মনোসামাজিক সহায়তা সেবা (পিএসএস) অন্তর্ভুক্ত করা।
অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য তৈরি মানসিক স্বাস্থ্য মডেলগুলো ব্র্যাকের অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিভাগ এবং অংশীদারদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়া।
শুধুমাত্র ফেরত আসা অভিবাসীদের জন্য নয়, যাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি রয়েছে এমন সকলের জন্যই কৌশলগত পরিকল্পনায় মানসিক স্বাস্থ্যকে অন্তর্ভুক্ত করা।
সদ্য স্নাতকদের পরিবর্তে প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের নিয়োগ দেওয়া। তবে এসব ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত পেশাজীবী না পাওয়া গেলে, সদ্য স্নাতকদেরও নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
সেবা প্রদানকারীদের দক্ষতা এবং চাহিদার ওপর ভিত্তি করে যাচাই এবং মূল্যায়ন নিয়মিত বিরতিতে অব্যাহত রাখা, এবং মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রশিক্ষণের আয়োজন করা।
দলগত এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ের কাউন্সেলরদের জন্য ক্লিনিক্যাল তত্ত্বাবধান অব্যাহত রাখা। যা কাউন্সেলরদের কর্মজনিত শারীরিক ও মানসিক অবসন্নতা প্রতিরোধ করার পাশাপাশি পেশাগত উন্নয়নও নিশ্চিত করবে।
বিদেশ-ফেরতদের, বিশেষত ফেরত আসা নারীদের, সম্পর্কে বিরূপ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে জন-সচেতনতা মূলক কর্মসূচি পরিচালনা করা।