মেয়াদোত্তীর্ণ হচ্ছে হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি

গোলাম সাত্তার রনি
০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
মেয়াদোত্তীর্ণ হচ্ছে হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি

চলতি বছর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অত্যাধুনিক থার্ড টার্মিনালের নির্মাণকাজ শেষ হচ্ছে না। এ ছাড়া আগামী বছরের প্রথম দিকে টার্মিনালটি পুরোপুরি চালু হওয়ার কথা থাকলেও তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বলছে, টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হতে এখনও এক থেকে দেড় বছর সময় লাগবে। এদিকে থার্ড টার্মিনালে স্থাপিত অনেক যন্ত্রপাতির ওয়ারেন্টির মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে রয়েছে আরও অনেক যন্ত্রপাতি। ফলে এসব যন্ত্রপাতির কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। নতুন করে ওয়ারেন্টির (রক্ষণাবেক্ষণ) মেয়াদ বাড়ানোর জন্য চুক্তি করতে হবে বেবিচককে। এতে গচ্চা যাবে বাড়তি অর্থ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে মেগা প্রকল্প থার্ড টার্মিনালের কাজ শেষ হওয়ার আগেই ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর তড়িঘড়ি করে উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর লক্ষ্য ছিল তৎকালীন সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- প্রচার করা। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, থার্ড টার্মিনালের কাজ ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে তৃতীয় টার্মিনাল থেকে ফ্লাইট পরিচালনা করা যাবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। অক্টোবরের মধ্যে টার্মিনালটি চালু করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে বেবিচক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা কারণে এখনই চালু করা যাচ্ছে না। তবে আগামী বছর শেষ দিকে চালু করা সম্ভব হতে পারে। অত্যাধুনিক টার্মিনালটির অনেক কাজই বাকি রয়েছে। এখনো টার্মিনাল পরিচালনার মাস্টার প্ল্যান (রূপরেখা) তৈরি হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে চুক্তি এখনো সম্পন্ন হয়নি। এ ছাড়া প্রায় ৬ হাজার লোকবল নিয়োগ দিয়ে তাদের ট্রেনিংও দিতে হবে। এ জন্য আরও সময়ের প্রয়োজন।

এদিকে চালু হতে দেরি হওয়ায় থার্ড টার্মিনালে স্থাপন করা অনেক যন্ত্রপাতির ওয়ারেন্টির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে এয়ার ফিল্ড গ্রাউন্ড লাইটিং। এ ছাড়া অনেক যন্ত্রপাতির মেয়াদ অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচকের এক কর্মকর্তা জানান, থার্ড টার্মনাল চালুর আগেই বেশ কিছু যন্ত্রপাতির ওয়ারেন্টি মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। বোর্ডিং ব্রিজ, কনভেয়ার বেল্টসহ কিছু যন্ত্রপাতি সচল রাখতে কয়েক দিন পরপর চালু করা হচ্ছে। না হলে সেগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী কিছু যন্ত্রপাতির মেয়াদ টার্মিনাল চালু হওয়ার পর শুরু হবে। সেগুলো নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তবে যেগুলোর ওয়ারেন্টির মেয়াদ শেষ হয়েছে বা হয়ে যাবে, সেগুলোর জন্য নতুন করে ওয়ারেন্টি চুক্তি করতে হবে। এর জন্য বেবিচককেই বাড়তি অর্থ গুনতে হবে।

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, আমরা দ্রুত থার্ড টার্মিনাল চালু করতে কাজ করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে ৯৮.৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট কাজ দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কাজ শেষ হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, কনস্ট্রাকশন কাজ প্রায় শেষ। অপারেশনাল কাজ কিছু বাকি আছে। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি ইন্টিগ্রেশন করতে হবে। সেগুলো করতে সময় লাগবে। আগামী ১ থেকে ২ মাসের ভেতরে জাপানের সঙ্গে একটা চুক্তি হবে। চুক্তির মেয়াদ ৬ মাস। এরপর এয়ারপোর্ট রান করতে ১ থেকে ২ মাস লাগবে। সে হিসাবে আগামী বছরের মাঝামাঝিতে থার্ড টার্মিনাল চালু হবে বলে আশা করছি। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে একটা নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়ে আছে বলেও জানান তিনি।

বেবিচক বলছে, ৯৮.৫ শতাংশ যে কাজ শেষ হয়েছে তা মূলত কনস্ট্রাকশন কাজ। যন্ত্রপাতি ইন্টিগ্রেশন ও ক্যালিব্রেশনের কাজ এখনো বাকি আছে, এগুলো করতে সময় লাগবে। এ ছাড়া অপারেশনাল ইকুইপমেন্ট কেনা বাকি। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়নি। অথচ বলা হচ্ছে, এই অক্টোবরে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টার্মিনালের দায়িত্ব বুঝে নেবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে টার্মিনালটি পুরোপুরি অপারেশন যাবে।

বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, টার্মিনালে অপারেশন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তার জন্য ৬ হাজার দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন হবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য প্রায় ৪ হাজার কর্মীর প্রয়োজন হবে। আগামী বছরের প্রথম দিকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ কর্মী নিয়োগ দেওয়া হবে এবং জুন-জুলাইতে টার্মিনালটি পুরোপুরি চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে বিমানবন্দরটি পরিচালনার বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়নি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এ কারণে পরিচালন ব্যয় নির্ধারণে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) চুক্তিও করা যায়নি। আগামী ১ থেকে ২ মাসের মধ্যে চুক্তি হবে। এরপর পুরনো টার্মিনাল থেকে নতুন টার্মিনালে সবকিছু স্থানান্তরে অপারেশন রেডিনেন্স অ্যান্ড এয়ারপোর্ট ট্রান্সফার (ওআরএটি) প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। পিপিপি চুক্তি হয়ে গেলে পুরনো টার্মিনালের অনেক কার্যক্রম তৃতীয় টার্মিনালে স্থানান্তর শুরু করবে বেবিচক। এরপর বেবিচকের নিজস্ব জনবলের ট্রেনিং ও ট্রায়াল চলবে। এসব প্রক্রিয়া শেষ হতে এক থেকে দেড় বছর পর্যন্ত সময় প্রয়োজন।

বেবিচকের এক কর্মকর্তা বলেন, হঠাৎ করে টার্মিনালের অপারেশন প্রক্রিয়াটা শুরু করা যায় না। টেস্ট অ্যান্ড ট্রায়াল করতে হয়, তারপর এসওপিগুলো তৈরি করতে হয়। বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের জায়গা দিতে হয় টার্মিনালে। তারপর নিজেদের মধ্যে আবার সেই সমন্বয়টা করতে হয়।

২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর একনেকে অনুমোদন পায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প ফেজ-১। ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর প্রকল্পের প্রথম সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদিত হয় ২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকার। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি রোহানি বাহারিনের করা নকশায় তৃতীয় টার্মিনাল ভবন নির্মাণ করছে জাপানের মিতসুবিশি ও ফুজিটা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং, যার নাম দেওয়া হয়েছে এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম।

তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে আরও ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। আর বর্তমানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রথম ও দ্বিতীয় টার্মিনালে দিনে ৩০টির বেশি উড়োজাহাজ সংস্থার ১২০ থেকে ১৩০টি বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। প্রতিদিন এসব উড়োজাহাজের প্রায় ২০ হাজার যাত্রী বিমানবন্দরের দুটি টার্মিনাল ব্যবহার করেন। এই হিসাবে বছরে প্রায় ৮০ লাখ যাত্রীর সেবা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।