সংস্কার কর্মকাণ্ডে অগ্রগতি আশানুরূপ নয়: কর্নেল অলি
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রায় ২ মাস সময় পূর্ণ করেছে। এই সরকারের কাছে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা অনেক, তবে এখনো মানুষের মধ্যে এক ধরণের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা কাজ করছে। কারণ সংস্কার কর্মকাণ্ডে অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। কোনো অবস্থাতেই দেশের মানুষকে নিরাশ করা যাবে না। সরকারকে সাহায্য করার জন্য সবাই এগিয়ে আসতে হবে। যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে দক্ষ, শিক্ষিত এবং উপযুক্ত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে। আমাদের পক্ষ থেকে সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
আজ শনিবার সকালে রাজধানীর মগবাজারের এলডিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
অলি আহমদ বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলে মনে হয় যে, তাদের অনেকেই ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি দুর্বল। অথচ ওই আওয়ামী স্বৈরাচারী সরকার গণআন্দোলনের সময় ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। বিশেষত গত ১৫ বছরে গণতন্ত্রকে নিশ্চিহ্ন ও ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে। অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন, বিচার ব্যবস্থা ও নির্বাচন পদ্ধতি ধ্বংস করেছে। সর্বস্তরে আত্তীকরণ ও দলীয়করণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম-খুন, জনগণের ওপর নির্যাতন-জুলুম, মেগা প্রকল্পের আড়ালে ব্যাপক দুর্নীতি, বিশাল ঋণ নিয়ে লুটপাট এবং বিদেশে লক্ষ কোটি টাকা পাচার এসব নজিরবিহীন অপরাধ সংঘটিত করেছে। সুতরাং এই দেশে তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নাই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের প্রশ্ন, তাদের নিবন্ধন বাতিল-করার জন্য আরও কত মানুষ শহীদ হওয়ার প্রয়োজন ছিল? বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা যুক্তিযুক্ত। অন্যথায় শহীদদের রক্ত বৃথা যাবে। সময় সীমিত, দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করুন এবং আবেগের পরিবর্তে বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত নিন।
অলি বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে শেখ মুজিবুর রহমান স্বেচ্ছায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও তার স্বেচ্ছাচারী শাসনে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বারবার নিগৃহীত হয়েছেন। তিনি কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক বা জাতির পিতা হতে পারেন না। তার একনায়ক-সুলভ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে হাজারও মানুষ খুন এবং গুম হয়েছেন, কিন্তু তবুও তার প্রতি একটি ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছে। এখনো বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে শেখ মুজিব এবং তার পরিবারের সদস্যদের নাম বিদ্যমান রয়েছে। এই নামগুলো অবিলম্বে পরিবর্তন করা জরুরি এবং ব্যক্তিপূজার অপসংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে ফেলতে হবে। পাশাপাশি, আমরা আশা করি সরকার বিভিন্ন ধরনের টাকার নোট থেকেও শেখ মুজিবের ছবি অপসারণ করবে।
তিনি বলেন, স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করতে গিয়ে সর্বমোট ১৫৮১ জন শহীদ হয়েছে (দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। সরকারের উচিত জনসম্মুখে তুলে ধরা- কত জন ছাত্র ছাত্রী, কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে শহীদ হয়েছে? কোন রাজনৈতিক দলের কত জন শহীদ হয়েছে এবং সাধারণ মানুষ কত জন শহীদ হয়েছে। এছাড়া অনুরূপভাবে আহতদের তালিকাও প্রস্তুত করা প্রয়োজন। এতে করে জনগণ একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাবে। এলডিপির শহীদ হয়েছে ৪ জন, অঙ্গহানি হয়েছে ৪ জন, আহত হয়েছে ১৫ জন।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেন, স্বৈরাচারী ও খুনি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন যে সমস্ত উপদেষ্টা বা কর্মকর্তা গণতন্ত্র হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য দায়ী তাদেরকে এখনো কেন গ্রেপ্তার করা হয় নাই?
৫ আগস্ট স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের পর পরই হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ইউনিফর্ম পরিহিত কয়েকশ ব্যক্তি দৌড়ে দৌড়ে ভারতের বিশেষ বিমানের মাধ্যমে পালিয়ে যায়। এরা কারা তা জনগণের জানার অধিকার রয়েছে।
কর্নেল অভি অভিযোগ করেন, দেশে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৮/১০ জন বড় বড় ক্রিমিনাল রয়েছে। যারা একনায়কত্ব কায়েম করার জন্য শেখ হাসিনাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে। এই ক্রিমিনালগুলো দেশের ব্যবসা বাণিজ্য এবং অর্থনীতি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেছে বড় বড় প্রকল্পগুলি নিয়ন্ত্রণ করেছে। এদের মধ্যে অনেকে অনৈতিক কাজেও লিপ্ত ছিল। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দেশের অর্থনীতি এবং গণতন্ত্রকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছে। রাজনীতিবিদরা তাদের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করেছে। অন্যদিকে তাদের চুরির টাকাও বিদেশে পাচার করে ব্যাংকগুলোকে ঋণগ্রস্ত করেছে। কিছু কিছু রাজনৈতিক দল, রাজনীতিবিদ, এমপি এবং মন্ত্রীদের তাদের কেনা গোলাম হিসেবে ব্যবহার করেছে। যার কারণে এদের কর্মকাণ্ডগুলো প্রকাশ্যে আসছে না। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার কয়েকদিন পূর্বেও এই ক্রিমিনাল ব্যবসায়ীরা তাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। এরা দেশদ্রোহী, জনগণের শত্রু এবং মানুষের রক্ত চুষে খেয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে চৌকস অফিসারদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তদন্তের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে। বিদেশে পাড়ি দেওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে এবং যারা বিদেশে অবস্থান করছে তাদেরকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় আগামীতেও দুর্নীতি বন্ধ হবে না।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অহেতুক সময় ক্ষেপণ করছে। তাদের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয়, তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে রাখার পরিকল্পনা করছে। কারণ প্রায় দুই মাস সময় অতিক্রান্ত করার পরও এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের আদালতগুলিতে স্বৈরাচারী সরকারের নিয়োগ দেওয়া পিপিরা কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া আওয়ামীপন্থী বিচারকরা নিজ নিজ অবস্থানে বহাল তবিয়তে আছে। ফলে সাধারণ মানুষ ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
২০১৪ সালের পর থেকে যে সব ব্যক্তি ইউনিয়ন ও উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, এমপি এবং মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, তাদের সকলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া তাদের অবৈধ সম্পদ ও দাখিলকৃত আয়কর রিটার্ন মিলিয়ে দেখা যুক্তিযুক্ত।
পশ্চিমবঙ্গ এবং দিল্লির বিভিন্ন সংগঠন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য অব্যাহত রেখেছে। ভারত কিভাবে আশা করে, এ ধরণের উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার পরও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন হবে? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত এই বিষয়গুলি ভারত সরকারের নিকট উত্থাপন করা এবং প্রতিবাদ করা। এছাড়া ভারত এদেশের বিগত সরকারের বড় বড় দুর্নীতিবাজদের আশ্রয় দাতার ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জুন ২০২৪ এ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশের শতকরা ৯১.৫৮ শতাংশ মানুষ মুসলমান। শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।
প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে ভর্তি ফি অনৈতিকভাবে ১৫/২০ লাখ টাকা আদায় করা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ধরণের অনৈতিক ব্যবসা বন্ধ করতে হবে এবং ভর্তি ফি সাধারণ মানুষের সক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এই ব্যাপারে সরকারকে সমন্বিতভাবে পদক্ষেপ করতে হবে।
আমাদের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রাইমারি স্কুল সমূহের প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী শিক্ষকদের টাইম-স্কেলের বৈষম্য রয়েছে। যার ফলে তাদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। প্রাথমিক-স্তরে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত।