বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ

নিউইয়র্কে ড. ইউনূস

আরিফুজ্জামান মামুন, নিউইয়র্ক জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ


প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বর্তমান সরকার দেশে মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তার সরকার কোনো সমালোচনায় বিরক্ত হয় না, বরং সমালোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে স্থানীয় সময় বুধবার নিউইয়র্কে বিশ্বের অর্ধডজনেরও বেশি শীর্ষ মানবাধিকার সংস্থার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এ মন্তব্য করেন। প্রধান উপদেষ্টা এদিন ব্যস্ত সময় পার করেন; অংশ নেন সিরিজ বৈঠক ও অনুষ্ঠানে। একই দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিশ^ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, নেপালের প্রধানমন্ত্রী ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাক্ষাৎ করেন।

নিউইয়র্কের একটি হোটেলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলাপকালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। অর্থনৈতিক সহযোগিতা, রোহিঙ্গা সংকট, সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ, শ্রম সমস্যা ও পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের বিষয়েও এ সময় আলোচনা হয়। এছাড়া তারা দুদেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়েও কথা বলেন। এর আগে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গেও পাশর্^বৈঠক করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সে সময় বাংলাদেশ সরকারকে পূর্ণ সমর্থনের কথা জানান বাইডেন এবং যে কোনো প্রয়োজনে বাংলাদেশ সরকারের

পাশে থাকার আশ্বাস দেন।

মানবাধিকার সংস্থার কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎ : বুধবার নিউইয়র্কে শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর

জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠকে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনা সরকারের শাসন আমলে চালানো নৃশংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার ও জবাবদিহির বিষয়ে আলোচনা হয়।

বৈঠকে শেখ হাসিনার আমলে প্রায় তিন হাজারের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্তের ওপর গুরুত্বারোপ করেন মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা। তারা নিরাপত্তা খাত সংস্কার, সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং অধিকতর তদন্ত, একনায়কতন্ত্রের সময় বলপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের রাখা ডিটেনশন কেন্দ্রগুলোতে অবাধ প্রবেশাধিকার এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। বৈঠকে ৯ সদস্যের প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব দেন রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসের প্রেসিডেন্ট কেরি কেনেডি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস ক্যালামার্ডও এ বৈঠকে যোগ দেন।

অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত সবার কাছে একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠানো যে, নতুন বাংলাদেশ মানবাধিকার পরিস্থিতি বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। পূর্ববর্তী শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন আমলে কীভাবে নাগরিকদের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার খর্ব হতো এবং অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কী কী করছে, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেন ড. ইউনূস। অনুষ্ঠানে আরও কথা বলেন হংকংভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনের সাবেক অ্যাক্টিভিস্ট মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সিনিয়র গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার প্রমুখ।

৩.৫ বিলিয়ন ডলার দেবে বিশ্বব্যাংক : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে সাড়ে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করবে। বুধবার নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা এ সহায়তার ঘোষণা দেন। অধ্যাপক ইউনূসের দীর্ঘদিনের বন্ধু অজয় বাঙ্গা বলেন, কমপক্ষে ২ বিলিয়ন ডলার হবে নতুন ঋণ এবং আরও ১.৫ বিলিয়ন ডলার বিদ্যমান কর্মসূচির অধীনে পুনঃব্যবহার করা হবে। তিনি জানান, বিশ্বব্যাংক ডিজিটালাইজেশন, তারল্য সংকট উত্তরণ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ এবং পরিবহন খাতের সংস্কারে সহায়তা দিতে এই ঋণ দেবে।

সাক্ষাৎকালে অধ্যাপক ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গৃহীত ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার কর্মসূচির জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তা কামনা করেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের ঋণ কর্মসূচিতে উদ্ভাবন আনার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘দেশ পুনর্গঠনের এটি একটি বড় সুযোগ।’

সাক্ষাৎকালে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান উপস্থিত ছিলেন।

চীন সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে চায় : চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, তার দেশ বাংলাদেশে সোলার প্যানেলে বিনিয়োগ করতে চায় এবং বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করার মাধ্যমে কৌশলগত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে আগ্রহী। বুধবার নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি এ কথা বলেন। 

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, অধ্যাপক ইউনূসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে চীনা সোলার প্যানেল প্রস্তুতকারকরা বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনে আগ্রহী। চীনা সরকার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছে। গত মাসে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি চীনের সোলার প্যানেল প্রস্তুতকারকদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছিলেন।

শফিকুল আলম বলেন, সাক্ষাৎকালে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক ইউনূসকে ‘চীনের জনগণের পুরনো বন্ধু’ উল্লেখ করেন এবং তাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য অভিনন্দন জানান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই জানান, গণ-অভ্যুত্থানের সময় গুরুতর আহত ছাত্র-জনতাকে চিকিৎসা দিতে চীনের রেড ক্রস চিকিৎসকদের একটি টিম ঢাকায় পাঠিয়েছে। তিনি বলেন, চীন বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানাবে।

অধ্যাপক ইউনূস এই আন্তরিকতার জন্য চীনকে ধন্যবাদ জানান। প্রধান উপদেষ্টা চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ‘নতুন অধ্যায়’ সূচনার আহ্বান জানান।

নেপালের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে জ্বালানি, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোদারের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। বুধবার নিউইয়র্কে তাদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এ আলোচনা হয়। দুই নেতা বাংলাদেশে নেপালি শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির কথা স্বীকার করেন। বৈঠক শেষে নেপালের প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে আমি আনন্দিত। তার সঙ্গে আমার নেপাল-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, অধ্যাপক ইউনূস ও কেপি শর্মা ওলির মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে দুই নেতা ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে জ্বালানি ও বাণিজ্য সহযোগিতা বাড়ানোর উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি আরও জানান, নেপালের জলবিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত রয়েছে এবং দেশটি দুই-তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জলবিদ্যুৎ রপ্তানিতে সক্ষম হবে। বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সম্ভবত নেপাল থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টা নেপালের প্রধানমন্ত্র সঙ্গে তার থ্রি জিরো আইডিয়া শেয়ার করেছেন।