তিন পক্ষই খুঁজছে সমাধানের পথ

গতকালও বন্ধ ছিল ৫২ কারখানা

আব্দুল্লাহ কাফি ঢাকা, জাহিদুর রহমান সাভার ও ফয়সাল আহমেদ গাজীপুর
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
তিন পক্ষই খুঁজছে সমাধানের পথ

ফের অশান্ত হয়ে উঠেছে সাভার-আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল। বকেয়া বেতনের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকরা। কয়েকদিন পরিস্থিতি তুলনামূলক স্বাভাবিক থাকলেও গতকাল চিত্র ছিল ভিন্ন। আশুলিয়ার জিরাবো, নরসিংহপুর, জামগড়া এলাকার ৫২টি পোশাক কারখানা গতকাল থেকে ফের অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়, এর আগের দিনও বন্ধ ছিল ২২টি কারখানা। এতে বিদেশি ক্রেতাদের কার্যাদেশ হারানোর আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন মালিকপক্ষ। তবে অন্যান্য কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম স্বাভাবিক। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শিল্প পুলিশ আশুলিয়া জোনের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারওয়ার আলম। এদিকে পোশাকশিল্পে শ্রমিক অসন্তোষের

সমাধান খুঁজতে সরকার, মালিক ও শ্রমিক এই তিন পক্ষ দফায় দফায় বৈঠক করেছে। পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম জানান, আমরা সমাধানের পথ খুঁজছি। সরকার ও শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

আজ মঙ্গলবার একটি ভালো সংবাদ নিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে ব্রিফ হওয়ার কথা রয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান।

এদিকে শ্রমিকদের দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার। তিনি বলেন, শিল্পকে বাঁচিয়ে দাবি আদায় করতে হবে। আন্দোলনের কারণে শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেলে ব্যবসা চলে যাবে অন্য জায়গায়। আমরা প্রতিনিয়ত সরকার ও মালিকদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি সমাধানের জন্য।

এদিকে পোশাকশিল্প খাতে বিদ্যমান অস্থিরতা ও সমস্যা নিরসনে সরকারের কাছে ১৮টি দাবি উত্থাপন করেছে শ্রমিক পক্ষ। সেগুলোর মধ্যে মজুরি বোর্ড পুনর্গঠন করে মজুরি পুনর্নির্ধারণ ও বাৎসরিক ন্যূনতম ১০ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের দাবি ছিল। তবে সেই দাবি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বিজিএমইএ। গতকাল এ সিদ্ধান্তের কথা জানায় সংগঠনটি।

জানা গেছে, দুই মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে জেনারেশন নেক্সট গার্মেন্টসের শ্রমিকরা গতকাল সকালে আশুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকায় সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন। বেলা ১১টার পর সেনাবাহিনী ও পুলিশ তাদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়।

শিল্পাঞ্চলে এক হাজার ৮৬৩টি কারখানার মধ্যে চলমান সংকটের আগে থেকেই বন্ধ ছিল ১৬৭টি। নতুন করে ৫২টিসহ ২১৯টি কারখানা বন্ধ থাকায় গভীর অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন তৈরি পোশাক শ্রমিকরা।

স্থানীয়রা জানায়, বোনাস, টিফিন বিল, নাইট বিল বৃদ্ধি বাস্তবায়ন না হওয়ায় রবিবার বিভিন্ন কারখানায় বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। অজানা আশঙ্কায় ছুটি ঘোষণা করার পর গতকাল থেকে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী হা-মীম গ্রুপের দ্যাটস ইট স্পোর্টস ওয়ার, অ্যাপারেল গ্যালারি, রিফাত গার্মেন্টস, এক্সপ্রেস ওয়াশিং অ্যান্ড ডাইং, আর্টিস্টিক ডিজাইন ও নেক্সট কালেকশন লিমিটেডের কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তাদের অনুসরণ করে এনভয়, দি রোজ গার্মেন্টস, ইউকোরিয়া অ্যাপারেলস, জেবারেস নেক্সট, সিন সিন অ্যাপারেল, টেক্সট ম্যাক্স, মেহনাজ স্টাইল, ও রেডিয়ান্স কারখানা বন্ধ ঘোষণা করায় পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, চলমান সহিংসতা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিবেচনায় শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। শ্রম আইনের ধারা ১৩ (১) অনুযায়ী দৈনিক ভিত্তিক কাজ নেই মজুরি নেই নীতিমালায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ রাখায় শ্রমিকরা বেতন-ভাতা পাবেন না। কারখানার পরিবেশ নিরাপদ হলে শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কারখানা খোলার তারিখ নোটিশের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে।

এদিকে নজিরবিহীন নিরাপত্তা সত্ত্বেও বন্ধ কারখানার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন বিদেশি ক্রেতারা। অনিশ্চয়তায় নতুন করে কার্যাদেশ আসছে না বলেও জানিয়েছেন বেশ কয়েকটি কারখানার মালিক।

বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেছেন, নিরাপত্তাসহ নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও পরিস্থিতির হেরফের হচ্ছে না। কোথাও কোথাও ন্যূনতম বেতন ২৫ হাজার টাকা দাবি করায় নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কারখানা চালু রাখার মতো অবস্থা নেই।

শিল্প মালিকদের অভিযোগ, আর্মড পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি এমনকি সেনাবাহিনীর সাপোর্ট পেয়েও শিল্প পুলিশ আগের মতো সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে না। বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা নিয়ে সেনাবাহিনী নামিয়েও কার্যকর ফল মেলেনি। তবে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারওয়ার আলম বলেন, বলপ্রয়োগ করে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া মোকাবিলার কৌশল আগেও ফল দেয়নি, এবারও দেবে না। বরং পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হবে। পরস্পরের সমঝোতার মাধ্যমেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।

সহিংসতা এড়াতে শিল্পাঞ্চলে যৌথবাহিনীর সমন্বয়ে পুলিশ, আর্মড পুলিশ, শিল্প পুলিশ, বিজিবি ও সেনা সদস্যদের টহল অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন কারখানার সামনে মোতায়েন রয়েছে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান, র‌্যাব, পুলিশের রায়ট কার ও জলকামান।

গাজীপুরে মহাসড়ক অবরোধ

গাজীপুর সদর উপজেলার বাঘের বাজার এলাকার গোল্ডেন রিফিট গার্মেন্টসের শ্রমিকরা ১২ দফা দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করেন। গতকাল সকালে শ্রমিকরা কারখানায় প্রবেশ করলেও কাজে যোগ না দিয়ে হাজিরা বোনাসসহ কয়েকটি দাবিতে অ্যাসেম্বলি পয়েন্টে অবস্থান নেন। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। এতে চান্দনা চৌরাস্তা থেকে মাওনা পর্যন্ত যানজট সৃষ্টি হয়। কারখানা কর্তৃপক্ষ ১২টি দাবির মধ্যে ৮টি মেনে নিলে শ্রমিকরা সড়ক ছেড়ে দেন। বাকি চারটি দাবির বিষয়ে তারা আশ্বাস পেয়েছেন।

এদিকে টঙ্গীর খাঁপাড়া এলাকায় সিজন্স ড্রেসেস-এর শ্রমিকরাও বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করেন। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোহাম্মদ বাহার জানান, শ্রমিকদের ১৫ দিনের বকেয়া থাকায় তারা বিক্ষোভ করছেন। তিনি বিষয়টি দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দেন।

শিল্প পুলিশ ও কারখানা সূত্রে জানা যায়, সিজন্স ড্রেসেসে ১৬শ শ্রমিক কাজ করেন। কারখানাটিতে গত জুলাইয়ের অর্ধেক ও আগস্টের পুরো বেতন বকেয়া আছে। ১৭ সেপ্টেম্বর বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করলে কারখানা কর্তৃপক্ষ জুলাইয়ের অর্ধেক বেতন পরিশোধ করে। বাকি অর্ধেক গত রবিবার পরিশোধের কথা থাকলেও তা করা হয়নি।

অন্যদিকে গতকাল সকাল ৮টা থেকে টঙ্গীর সাতাইশ বাগান বাড়ি এলাকার প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটারের প্রায় ৩শ শ্রমিক আগস্টের বেতনের দাবিতে গাজীপুরা এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিং মহাসড়ক অবরোধ করেন।

৬ জন আটক, ৩ কারখানা বন্ধ

গাজীপুরের কালিয়াকৈরের মৌচাক এলাকায় কোকোলা ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেডের শ্রমিকরা ১২ দফা দাবিতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। গতকাল সকালে বিক্ষোভ চলাকালে বিশৃঙ্খলার অভিযোগে সেনাবাহিনী ৬ জনকে আটক করে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বিক্ষোভের কারণে কারখানাটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়াও কালিয়াকৈরের আরও তিনটি কারখানাও বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

শিল্প পুলিশ জানায়, শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা করার দাবি দীর্ঘদিনের হলেও মালিকপক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ জন্য কারখানার সামনে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করতে থাকেন। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির অভিযোগে ৬ জনকে আটক করা হয়। সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের (জোন-২) পরিদর্শক নিতাই চন্দ্র সরকার জানান, কারখানা বন্ধ ঘোষণার পরও কিছু শ্রমিক জোর করে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুরের চেষ্টা করছিলেন। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এদিকে গাজীপুরে দিনভর শ্রমিক আন্দোলনে উত্তাল থাকার পর ১৩টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।