লোডশেডিং বাড়ছেই
সারাদেশে এক সপ্তাহ ধরে বেড়েছে লোডশেডিং। শহরের তুলনায় গ্রামে আরও বেড়েছে। গরমের মধ্যে এমন অস্বাভাবিক লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। এর প্রভাব পড়ছে কলকারখানা ও ব্যবসাতে। ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারা, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কম চালানো এবং ডলার সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানির বিল পরিশোধ করতে না পারায় নানা সংকটে পড়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় কম উৎপাদন হচ্ছে। চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগকে। সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দ্রুতই লোডশেডিংয়ের সমস্যা সমাধান হবে। তবে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কেন্দ্রগুলোর তথ্যমতে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে অন্তত তিন সপ্তাহ সময় লাগবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৫ বছর ধরে গরমের সময়টাতে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দেয়। তবে এবার অর্থসংকট এবং জ¦ালানির সংকট বেড়ে যাওয়ায় লোডশেডিং বেশি বেড়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দ্রুতই লোডশেডিংয়ের সমস্যা সমাধান হবে। বিদ্যুৎ সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, কয়েক দিন যাবৎ প্রায় গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হয়েছে। মূলত গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় লোডশেডিং বেড়ে গেছে। এ ছাড়া ভারতে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব ইউনিট। অন্যদিকে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানো যাচ্ছে না। ফলে লোডশেডিং বেড়েছে।
সূত্র জানায়, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দেশে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট। প্রয়োজনের সময় আগে সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে। এখন ৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
পিডিবি বলছে, ১২০০ থেকে ১৩০০ এমএমসিএফডি পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ
পেয়েছে বিদ্যুৎ খাত। এখন সরবরাহ হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ এমএমসিএফডি। ফলে অর্ধেকের বেশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকছে। এতে লোডশেডিং চরম আকার ধারণ করেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মাধ্যমে দিনে গ্যাস আসে প্রায় এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। কিন্তু সামিট কোম্পানির এলএনজি টার্মিনাল গত ২৭ মে থেকে বন্ধ। এতে এখন অর্ধেক গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক অবস্থায় আসবে বলে আশা করছি। তিনি বলেন, গ্যাসের সংকট, ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের পরিমাণ কমে যাওয়া, এলএনজি টার্মিনাল নষ্ট হওয়া এবং মার্কিন ডলার সংকটের কারণে লোডশেডিং হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে সরকার।
উপদেষ্টা বলেন, হঠাৎ করে কারিগরি ত্রুটির কারণে বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। একই সময়ে রামপালের একটি ইউনিটে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে। গ্যাস সরবরাহ ঠিক থাকলে এই সংকট সামাল দেওয়া সহজ হতো। কিন্তু সামিট গ্রুপের এফএসআরইউ (ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল) কয়েক মাস ধরে বিকল থাকায় গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না। এলএনজি আমদানির কাজ চলছে। ১৫-২০ দিন সময় লাগবে। তার পর গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে। গ্যাস সংকটে শিল্প, সার কারখানা সব জায়গায় সমস্যা হচ্ছে। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রামপাল দ্রুত চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হঠাৎ করেই সব সংকট এক সঙ্গে দেখা দিয়েছে। আগে থেকেই ডলার সংকটের কারণে বিল পরিশোধ করা যাচ্ছিল না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সামিটের এলএনজি টার্মিনালের সমস্যা। টার্মিনালটি তিন মাসের বেশি সময় ধরে নষ্ট থাকার পর ঠিক হলেও এখন টার্মিনাল থেকে সরবরাহের মতো গ্যাস নেই। এ ছাড়া ভারতের আদানির বিল পরিশোধ করতে না পারায় সরবরাহ কমেছে। এগুলো ছাড়াও বেশি সমস্যা হচ্ছে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়া। এতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানো যাচ্ছে না।
বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নয়ন করা হচ্ছে। ১১ সেপ্টেম্বর দুপুরের দিকে ১ হাজার মেগাওয়াটের মতো লোডশেডিং হয়েছে। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে পাম্পিং যন্ত্রটি বিকল হয়েছে, সেটি চীন থেকে বিমানে আনা হচ্ছে। আগামী রবিবারের মধ্যেই চালু হয়ে যাবে। এ ছাড়া রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল ইউনিট দ্রুত চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, আগে গ্যাস থেকে ৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যেত। গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় এখন ৪৮০০ মেগাওয়াট পাওয়া যাচ্ছে। এতে ২২০০ মেগাওয়াট ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
ভারতীয় কোম্পানি আদানি গ্রুপের পাওনা প্রসঙ্গে হাবিবুর রহমান বলেন, এখানে অর্থের সংকট নেই। আমরা সোনালী ব্যাংকে ১০০ মিলিয়ন টাকা দিয়ে দিয়েছি। তারা ডলারের অভাবে দিতে পারছে না। আমরা আরও টাকা দিতে পারি। আশা করি আদানির বিদ্যুৎ পেতে কোনো সমস্যা হবে না। আদানিকে সরবরাহ বাড়াতে বলা হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, সামিটের টার্মিনালটি এখন ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু বিগত দিনে এই টার্মিনাল নষ্ট হওয়ায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি অর্ডার বাতিল করা হয়েছিল। এখন আবার নতুন করে এলএনজি আমদানি করা হবে। এতে ১৫ থেকে বিশ দিন সময় লাগবে।
গতকাল সর্বশেষ পাওয়া তথ্যানুযায়ী দুপুর পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৫৭৮ মেগাওয়াট। দুপুর ১২টায় উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৮৬১ মেগাওয়াট। এ সময় লোডশেডিং হয়েছে এক হাজার ৬৪০ মেগাওয়াট। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, এ সময় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৪ হাজার ৯৩০ মেগাওয়াট, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে হয়েছে এক হাজার ৬০২, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে হয়েছে তিন হাজার ৬১৯, হাইড্রো বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে হয়েছে ২০৯, সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫০৮, বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১, ভেড়ামারা থেকে আসছে ৮৮৩ এবং ত্রিপুরা থেকে আসছে ৯০ মেগাওয়াট। এ ছাড়া আদানি থেকে আসছে এক হাজার ১৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
আমাদের পার্বতীপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি হাসান মাসুদ জানান, পার্বতীপুরে অবস্থিত বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ৩টি ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কোনো উৎপাদন হচ্ছে না। ফলে ৩০০ থেকে ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি সারাদেশে। এই বিদ্যুৎ উত্তরাঞ্চলসহ জাতীয় গ্রিডে সার্বক্ষণিক সরবরাহ করা হতো। দীর্ঘ ৩৬ দিন বন্ধ থাকার পর ৬ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় ২৭৫ মেগাওয়াটের ৩ নম্বর ইউনিটে উৎপাদন শুরু হয়। ৪ দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর সকালে তৃতীয় ইউনিটের অয়েলপাম্প (টারবাই-জেনারেটর) নষ্ট হলে উৎপাদন বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। তৃতীয় ইউনিট চালুর দিন গত ৬ সেপ্টেম্বর রাত পোনে ৯টায় কেন্দ্রের ১ নম্বর ইউনিটটি সংস্কার কাজের জন্য বন্ধ করা হয়। আর ২০২০ সালের নভেম্বর থেকেই কেন্দ্রের ২ নম্বর ইউনিট ওভারহোলিং কার্যক্রমের জন্য বন্ধ রয়েছে।
গতকাল বুধবার বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক আমাদের সময়কে জানান, ১ নম্বর ইউনিটটি বহুদিনের পুরাতন। ভাইব্রেশনের কারণে গত ৬ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ৯টায় সেটি বন্ধ করেছি। আশা করছি আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রের ১ নম্বর ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।