তিন মাসের মধ্যে সংস্কার
ছয় কমিশন গঠন, পরামর্শসভার ভিত্তিতে চূড়ান্ত রূপরেখা
রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তিন মাসের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষে পরামর্শসভার ভিত্তিতে চূড়ান্ত রূপরেখা প্রস্তুত করবে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল বুধবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ কথা জানিয়েছেন। সংস্কারের জন্য ছয়জনের নেতৃত্বে ছয়টি কমিশন গঠনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হওয়ার পর কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজ আগামী ১ অক্টোবর থেকে শুরু করতে পারবে বলে আশা করছি। এটি পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আমরা ধারণা করছি।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শসভার আয়োজন করবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্রসমাজ, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি নিয়ে তিন থেকে সাত দিনব্যাপী পরামর্শসভার ভিত্তিতে সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। এতে এই রূপরেখা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তার ধারণা দেওয়া হবে।
এই আয়োজন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বার্তা বাস্তবায়ন এবং রাষ্ট্র পুনর্নির্মাণ তাগিদের ঐক্যবন্ধনে গোটা জাতিকে শক্তিশালী ও আশাবাদী করে তুলবে বলে আমাদের বিশ্বাস।’
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের সামনে অনেক কাজ। সবাই মিলে একই লক্ষ্যে আমরা অগ্রসর হতে চাই।’ দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা সংস্কার চাই। আমাদের ওপর যে সংস্কারের গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন, সেই দায়িত্ব দিয়ে আপনারা দর্শক গ্যালারিতে চলে যাবেন না। সঙ্গে থাকুন। নিজ নিজ জগতে সংস্কার আনুন। একটা জাতির সংস্কার শুধু সরকারের সংস্কার হলে হয় না। ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী সমিতি, রাজনৈতিক কর্মীসহ সর্বত্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আছে। আমি এটাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণের জন্য সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি।’
গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী, সম্পাদক, ছাত্র, শ্রমিকসহ নানা পেশার সঙ্গে মতবিনিময় করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, তারা বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন, এখন আমাদের অগ্রসরের পালা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এবং হাজারো মানুষের আত্মদানের বিনিময়ে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সংস্কার ভাবনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা। আমরা যেহেতু জনগণের ভোটাধিকার ও জনগণের মালিকানায় বিশ্বাস করি, সেহেতু নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নয়ন আমাদের সংস্কার ভাবনায় গুরুত্ব পেয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের কথা আমরা ভাবছি। নির্বাচন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রশাসন, বিচার প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশনÑ এই চারটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য। এসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার জনমালিকানা ভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায়ও অবদান রাখবে। এর পাশাপাশি সমাজের সব স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব ও স্বার্থ নিশ্চিতে এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বার্তাকে প্রতিফলিত করতে সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজন আমরা অনুভব করছি।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘এসব বিষয়ে সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আমরা প্রাথমিকভাবে ছয়টি কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এসব কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয় বিশিষ্ট নাগরিককে দায়িত্ব দিয়েছি। এরপর আরও বিভিন্ন বিষয়ে কমিশন গঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখব।’ তিনি জানান, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসনে সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগে বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমনে ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসনে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন ড. শাহদীন মালিক। এসব কমিশনের অন্য সদস্যদের নাম কমিশন প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।
কথা দিচ্ছি, আপনাদের ন্যায্য আবেদনের কথা ভুলে যাব না
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
গত এক মাসে সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, ‘যে সমস্ত ভাইবোনরা তাদের গত ১৬ বছরের বেদনা জানিয়ে প্রতিকার পেতে আমার অফিস এবং সচিবালয়ের অফিসগুলোর সামনে প্রতিদিন কর্মসূচি দিয়ে কাজকর্ম ব্যাহত করছিলেন, তারা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে কর্মসূচি থেকে বিরত হয়েছেন বটে; তবে অন্যত্র আবার কর্মসূচি দিয়ে যাতায়াতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছেন। আমি কথা দিচ্ছি, আপনাদের ন্যায্য আবেদনের কথা ভুলে যাব না।’
শিল্প-কারখানা বন্ধ হলে অর্থনীতিতে বিরাট আঘাত পড়বে
তৈরি পোশাক ও ওষুধশিল্পের শ্রমিকদের আন্দোলন কর্মসূচি প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, ‘এটা আমাদের অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে সেটা মোটেই কাম্য নয়। আমরা অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চারের চেষ্টা করছি। ঠিক এ সময়ে আমাদের শিল্প-কারখানাগুলো বন্ধ বা অকার্যকর হয়ে গেলে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট আঘাত পড়বে। মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এসব সমস্যার সমাধান অবশ্যই বের করব। আপনারা কারখানা খোলা রেখে অর্থনীতির চাকা সচল রাখুন। আমরা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সর্বশক্তি প্রয়োগ করব। মালিক পক্ষের কাছে আবেদন, আপনারা শ্রমিকদের সঙ্গে বোঝাপড়া করুন। অর্থনীতির দুর্বল স্বাস্থ্যকে সবল করে তুলুন।’
সাগর-রুনিসহ ৫ হত্যাকা-ের বিচার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি
ড. ইউনূস বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতেই অন্তর্বর্তী সরকার বিচার বিভাগের বড় সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে। অতিসত্বর কালো আইন বাতিল ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধন করা হবে। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকা-সহ বহুল আলোচিত ৫টি হত্যাকা-ের তদন্ত ও বিচার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ও দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তির জন্য সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।
শিক্ষাব্যবস্থার দিকে নজর
প্রধান উপদেষ্টা জানান, শিক্ষাব্যবস্থার দিকে সরকারের পূর্ণ নজর রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা হয়েছে। বই সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ শেষ পর্যায়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। আমরা সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মিডিয়া যাতে কোনো রকম বাধাবিপত্তি ছাড়া নির্বিঘেœ কাজ করতে পারে, সে জন্য একটি মিডিয়া কমিশন গঠন করা সরকারের বিবেচনাধীন।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
মর্যাদার ভিত্তিতে ভারত ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও কূটনৈতিক সফলতা তুলে ধরতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তার অনুরোধে সংযুক্ত আরব আমিরাত ৫৭ জন বাংলাদেশিকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে। তিনি বলেন, ‘যে সমস্ত সরকারপ্রধানের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। তবে সেই সম্পর্ক হতে হবে ন্যায্যতা এবং সমতার ভিত্তিতে। ভারতের সঙ্গে ইতোমধ্যে বন্যা মোকাবিলায় উচ্চপর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার আলোচনা শুরু করেছি। দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সার্ক রাষ্ট্রগোষ্ঠী পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছি।’
দেশের পরিকল্পনা নেতা বা দলকেন্দ্রিক নয়
দেশের পরিকল্পনা যেন দেশের মানুষকেন্দ্রিক হয়, কোনো নেতা বা দলকেন্দ্রিক নয়Ñ উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকার লুটপাটের জন্য নতুন করে ষাট হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ায় মুদ্রাস্ফীতির শিকার হয়েছে দেশের মানুষ। তিনি জানান, প্রকৃত রাজস্ব আয় ও রপ্তানি আয় নিরূপণ ও প্রকাশের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পুঁজিবাজারকে স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন পুনর্গঠন করা হয়েছে। নিম্নআয়ের এক কোটি পরিবারকে টিসিবির মাধ্যমে হ্রাসকৃত মূল্যে চাল, সয়াবিন তেল ও মসুর ডাল দেওয়া হচ্ছে।
আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের উদ্যোগ
লুটপাট ও পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে একটা ব্যাংকিং কমিশনও গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে এই এক মাসে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। আরও অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করতে কাজ চলছে
ড. ইউনূস বলেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কোম্পানিগুলো অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনার লক্ষ্যে কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। প্রকৌশল, ভূতত্ত্ব ও খনিজ এবং হিসাব বিষয়ে অধ্যয়ন করেছে এমন ছাত্র প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করতে কাজ চলছে।
ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন কাজ করবেন না
একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রূপরেখা তৈরিতে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। কেউ সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করলে ই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব। আমরা একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন কোনো কাজ কেউ কোনোভাবেই করবেন না।