বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে শুভঙ্করের ফাঁকি

লুৎফর রহমান কাকন
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে শুভঙ্করের ফাঁকি

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অধিকাংশ কোম্পানি মূলত বছরের পর বছর ধরে লোকসানে আছে। লোকসানের যুক্তিতে গত ১৫ বছরে খুচরা-পাইকারি মিলে অন্তত ১৮ বার দাম বেড়েছে বিদ্যুতের। দফায় দফায় বেড়েছে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দামও। এসব খাতে প্রতি অর্থবছরেই হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে। এর মধ্যেই বিস্ময়কর হলেও সত্যি, বছর শেষে লাভ দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোটি কোটি টাকা ভাগ করে নিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এটি রীতিমতো শুভঙ্করের ফাঁকি।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) গণশুনানিতে কয়েক বছর আগে এ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করলেও তৎকালীন সরকার কোনো গুরুত্বই দেয়নি। গণশুনানিতে এমন নানা অনিয়মের প্রসঙ্গ তোলার কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বরং বিব্রত হতেন। ফলে সরকার একপর্যায়ে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য সমন্বয় প্রক্রিয়াই বরং বাতিল করে দেয়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন থেকে ফের গণশুনানিতেই দাম বাড়ানো হবে।

প্রাপ্ত তথ্যাদি বলছে, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান দেখিয়ে গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৪ বার বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। লোকসানের বোঝা এসে পড়েছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। এদিকে সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ, পিডিবি ও আরইবির অধীন বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা মুনাফা দেখাচ্ছে। মুনাফার ৫ শতাংশ ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে। অথচ প্রায় প্রতিটি কোম্পানিতে ভর্তুকি দিয়ে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হচ্ছে সরকারকে।

পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এক অর্থবছরে সংস্থাটি লোকসান দিয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে সরকারি ৫টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি লাভ করেছে দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি। সেই হিসাবে কর্মীদের প্রফিট বোনাস দাঁড়ায় ৭৫ কোটি টাকা। কোম্পানিভেদে একজন কর্মী বছরে ৩ থেকে ১৮ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রফিট বোনাস পাচ্ছেন বলে জানা গেছে। এভাবে প্রতিবছর বিদ্যুৎ কর্মীরা নিয়ে যাচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। অথচ বিদ্যুৎ বিভাগের আবেদনের প্রেক্ষিতে বছরে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে।

শুধু বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানিগুলো নয়, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোও একই কাজ করছে। কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) ২০২১-২০২২ অর্থবছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৮ লাখ টাকা করে বোনাস দিয়েছিল। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো) থেকে আয় করা দুই হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা পেট্রোবাংলাকে দেয়নি কেজিডিসিএল। নিজেদের লাভ দেখিয়ে বছর শেষে বোনাস নিয়ে নেয় তারা। বিইআরসির নির্দেশনা অনুসারে, বিতরণ চার্জ বাদে, গ্যাস বিক্রির সব আয় পেট্রোবাংলাকে দিতে হবে। কিন্তু ২০১০ সালে কেজিডিসিএল গঠনের পর থেকেই তা করা হয়নি। কর্ণফুলী এই অর্থ আয় করে বহুজাতিক কোম্পানি কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের (কাফকো) কাছ থেকে; গ্যাস কোম্পানিটি কাফকোর কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কোম্পানিগুলোর জন্য বিইআরসি নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে উচ্চদামে গ্যাস বিক্রি করে। অর্থাৎ নিজেদের লাভের জন্য কোম্পানিগুলো বছর শেষে লাভ দেখাচ্ছে। শুধু তাই নয়। পাঁচ তারকা হোটেলে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করে প্রতিষ্ঠানটি এজিএম করছে। অথচ সরকার এ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে প্রতিবছর।

এদিকে প্রফিট (মুনাফা) বোনাস পাওয়া কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের দাবি, শ্রমিক আইন অনুযায়ী কোম্পানির বার্ষিক মুনাফার ৫ শতাংশ বোনাস তারা পেয়ে থাকেন। এখানে আইনের ব্যত্যয় হয়নি। কিন্তু ক্রমাগত লোকসানে থাকা বিদ্যুৎ খাতের জন্য এ আইন কতটা প্রযোজ্য, এ নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে।

পিডিবির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, আইনটা দেখলে আপনিও বুঝবেন। আইনটা মূলত হয়েছিল গার্মেন্টস শ্রমিক, বেসরকারি শিল্প, কলকারখানা শ্রমিকদের জন্য। আইনে বলা আছে, প্রতিষ্ঠানের কর-পূর্ব মুনাফার পাঁচ শতাংশ কর্মীদের দিতে হবে।

শ্রমিক আইনে প্রতিষ্ঠানের সিইও (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) বা এমডিকে (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) বোনাসের আওতায় রাখা হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইনে বলা হয়েছে এই পদে সাধারণত প্রতিষ্ঠানের মালিক বা অংশীদাররা থাকেন। তিনি আরও বলেন, সরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানির সিইও বা এমডিরা প্রতিষ্ঠানের মালিক বা অংশীদার না। কিন্তু তারা প্রফিট বোনাস পান না। কারণ, আইনে এটাই বলা আছে। তাই বলা চলে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় এই আইন করা হয়েছিল। কারণ, মালিকরা শ্রমিক ঠকায়, এমন নজির অহরহ দেখা যায়। মালিকদের লাভের একটা অংশ শ্রমিকদের দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

সরকারি অন্যান্য চাকরির তুলনায় রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রায় আড়াই গুণ বেশি বেতন-ভাতা পান উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, প্রফিট বোনাসের এই আইন সরকারি বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয়।

পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৬ বছরে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাটি লোকসান দেখিয়েছে ২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ সময় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় ১৮৮ শতাংশ।

আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতা নেয়, তখনও লোকসান অনেক কম ছিল। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় লোকসান অনেক বেড়ে গেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পিডিবি লোকসান গুনেছিল ৮২৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। পরের অর্থবছরে ৬৩৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। দশ বছর পর, ২০২০-২১ অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসান হয়েছে ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এরপর হঠাৎ করেই লোকসান অনেক বেড়ে গেছে। ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪- এই তিন অর্থবছরে রেকর্ড এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি লোকসান হয়েছে পিডিবির। লোকসানের কারণে সরকার দেড় দশকে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিয়েছে। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পিডিবি বিভিন্ন বিদ্যুৎ কোম্পানিকে দিয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি ৫টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি নিট মুনাফা করেছে ১৫১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর ৫ শতাংশ প্রফিট বোনাস হিসেবে ওই অর্থবছর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেওয়া হয়েছে ৭৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। বেশি লাভে থাকা কোম্পানির কর্মীরা বেশি মুনাফা পেয়েছেন।

সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ, পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের অধীনস্থ লাভে থাকা কোম্পানিগুলো হলো- আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি (এপিএসসিএল), ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি (ইজিসিবি), নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (নওপাজেকো), রুরাল পাওয়ার কোম্পানি (আরপিসিএল) ও বি-আর পাওয়ার জেন (বিআরপিএল)। এর আগের তিন অর্থবছরও এই কোম্পানিগুলো লাভে ছিল।

পিডিবি লোকসান করে এবং এর অধীন কোম্পানিগুলো লাভ করে। এ বিষয়ে ক্যাবের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কোম্পানিগুলো যে লাভ দেখায় এগুলো শুভঙ্করের ফাঁকি।’

তিনি বলেন, ‘এ খাতে সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত যেখানে ঋণে জর্জরিত, সেখানে কোম্পানিগুলো কী করে লাভ করে?’

তিনি বলেন, ‘মূলত রাষ্ট্রের টাকা ভাগাভাগি করে নেওয়ার ক্ষেত্রে সবাই এক।’ এ খাতে সংস্কার জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘নিজের কোম্পানির কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনছে পিডিবি। দর যাচাই-বাছাই যেন না করা যায়, সে জন্য করা হয়েছে বিশেষ আইন। তিনি আরও বলেন, যাচাই-বাছাই যে করবে এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। কারণ চাকরি বাঁচাতে গেলে এগুলো করতে হয়। সঠিক কাজ করলে নানা রকম ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়।’

বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশের সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর একক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান পিডিবি। তারা বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে কম দামে দেওয়ায় লস হয়। বেশি দামে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তিগুলোতেই গলদ রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো লাভ করে মুনাফার একটা অংশ নিজেরা ভাগ করে নিচ্ছে। অথচ পুরো মুনাফাটা পিডিবিকে দেওয়া উচিত। তাতে সরকারের কাছ থেকে প্রতিবছর পিডিবির নেওয়া ভর্তুকির পরিমাণ কমে আসবে।’