প্লাস্টিক দূষণ রোধে প্রয়োজন বাস্তবসম্মত লক্ষ্যমাত্রা
বিশ্বের ৫১ শতাংশ প্লাস্টিক দূষণের জন্য দায়ী এশিয়ার দেশগুলো। প্লাস্টিক দূষণকারী শীর্ষ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও। বর্তমানে দেশে বছরে ৮ লাখ টনেরও বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মাত্র ৪০ শতাংশ টন রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার হয়। বাকি বিপুল পরিমাণ বর্জ্যের বোঝা থেকে যাচ্ছে পরিবেশে।
প্লাস্টিক দূষণজনিত ক্ষতির মাত্রা কমাতে প্লাস্টিক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের জন্য করা হচ্ছে এক্সটেন্ডেড প্রডিউসার রেসপনসিবিলিটি (ইপিআর)। ইপিআর হল একটি নীতিগত পদ্ধতি যেখানে উৎপাদকদের ওপর তাদের উৎপাদিত পণ্যের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পন করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিক দূষণ কমাতে প্রয়োজন বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা।
ইপিআর নীতিমালায় অগ্রাধিকার পেয়েছে পলিব্যাগ ও প্লাস্টিকের বোতলের মতো একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক (এসইউপি)। ২০২৭ সাল থেকে ৩০ শতাংশ এসইউপি নিষিদ্ধ করার কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানা গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই লক্ষ্যমাত্রা আরও সীমিত হওয়া উচিৎ। কারণ অনেক উন্নত দেশও এসইউপি নিয়ন্ত্রণে এত দ্রুত উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। জানা যায়, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও ইউরোপীয় কাউন্সিলের চুক্তি অনুসারে, একক ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে পাঁচ শতাংশ, ২০৩৫ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ১৫ শতাংশ।
ভারত প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আইনের আওতায় ২০১৮ সালে মাত্র তিন বছরে, অর্থাৎ ২০২২ সাল নাগাদ এসইউপি পণ্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধের ঘোষণা করে। ১৯ ধরণের পণ্যের তালিকা করা হয়, যা তিন বছরে বিভিন্ন মাত্রায় নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু উপযুক্ত বিকল্প না থাকায় এত কম সময়ে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। এখন ভারতের প্লাস্টিক বর্জ্যের মাত্র ১৫ শতাংশই রিসাইকেল করা হচ্ছে এবং দেশটির প্রায় সর্বত্রই একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ছড়াছড়ি।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
নেপাল ২০২১ সালে আইনের মাধ্যমে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে। আইন অনুযায়ী, ৪০ মাইক্রোনের কম পুরুত্বের প্লাস্টিকের ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এর আগে ২০১৫ সালেও একবার পলিব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু সুস্পষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ও জনসচেতনতার অভাবে, বিশেষত গ্রামীণ এলাকায়, তা কার্যত কোনো ফল দেয়নি।
অন্যদিকে, পরিবেশ রক্ষায় অগ্রণী দেশ ভুটান ১৯৯৯ সাল থেকেই প্লাস্টিক দূষণ রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এরপর ২০০৫ ও ২০০৯ সালে এসব পদক্ষেপ আওে ব্যপকহারে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে সরাসরি জরিমানা আরোপের আইন করে প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার রোধে আরও কঠোর অবস্থান নেয় দেশটির সরকার। তা সত্ত্বেও চোরাচালানির প্রকোপ ও জনসচেতনতার অভাবে এসইউপি পণ্য নিয়ন্ত্রণে দেশটি আশানুরূপ সফলতা পায়নি।
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের আরেক দেশ থাইল্যান্ড একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা শুরু করে ২০১৯ সালে। পণ্যভেদে বিভিন্ন মেয়াদে বা ধাপে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। শুরুর দিকে শুধু প্লাস্টিক ব্যাগ ও স্ট্র (পানীয় পানের নল) নিষিদ্ধ করা হয়। ২০২৩ সাল নাগাদ দেশটির নির্ধারিত অঞ্চলে এসইউপি পণ্যের ব্যবহার কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
থাইল্যান্ডের মতো আরেক পর্যটন রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরও ২০২০ সালে এসইউপি পণ্যের ওপর পদ্ধতিগত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, বিশেষত পর্যটন এলাকাগুলোতে। এছাড়া জনসচেতনতা বৃদ্ধিতেও দেশটি কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে ২০২৩ সালে মাঝামাঝি সময়ে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ব্যবহার ৩০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্য নিয়ন্ত্রণে কী পদক্ষেপ নিচ্ছে- তা বিশ্লেষণ করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষত, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্লাস্টিক দূষণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ’নির্দিষ্ট খাতে বিশেষজ্ঞরা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। তরুণ নেতৃত্বও এসেছে। পরিবেশ রক্ষায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুগঠিত ও সমন্বিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইপিআর নীতিমালা বাস্তবায়নের গুরুত্ব এ সরকার অনুধাবন করবে বলেই আমার বিশ্বাস। এক্ষেত্রে এসইউপি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিকল্প নেই। তবে এসইউপি পণ্য নিষিদ্ধের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা ধাপে ধাপে বাড়াতে হবে। এছাড়া এসইউপি শুধু নিষিদ্ধ করলেই হবে না, বাজারে এর অনুরূপ বা কাছাকাছি কোনো পরিবেশবান্ধব বিকল্প পণ্যকে সুলভ করতে হবে। পাশাপাশি, জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে। ভোক্তাদের সম্পৃক্ততা ও সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এ ধরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।‘