বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন উজ্জীবিত করেছে র‌্যাপ সং

তারেক আনন্দ
১৮ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন উজ্জীবিত করেছে র‌্যাপ সং

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রায় সব আন্দোলনে প্রতিবাদের ভাষা, অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয়েছে গান। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে একেকটি গান ছিল যেন কামান! ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে, আমরা ক’জন নবীন মাঝি হাল ধরেছি রে, জীবন কাটে যুদ্ধ করে, প্রাণের মায়া সাঙ্গ করে জীবনের স্বাদ নাহি পাই...।’ গীতিকার ও সুরকার আপেল মাহমুদের (সমবেত কণ্ঠে গাওয়া) এ গান শুনলে এখনো গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। এমন আরও অসংখ্য গান স্বাধীনতা যুদ্ধে যোদ্ধাদের সাহস, রণাঙ্গনে দিয়েছে অনুপ্রেরণা। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে বেশ কিছু র‌্যাপ সং আন্দোলনকারীদের উৎসাহ, উদ্দীপনা দিয়েছে। এসব গানে প্রতিবাদের ভাষা ছিল ব্যাপক আক্রমাণত্মক। ‘আওয়াজ উডা’ গানের জন্য গ্রেপ্তার হন র‌্যাপার হান্নান। এ ছাড়া অনেকে গা-ঢাকা দেন, কেউ কেউ শিকার হয়েছেন হামলা, নির্যাতনের। র‌্যাপার হান্নান বলেন, ‘আন্দোলনে আমার ভাই-বোনদের রাস্তায় মারা হচ্ছিল। আবু সাঈদের মতো অনেক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। সেই সময় আর চুপ থাকার অবস্থায় ছিলাম না। ভাবছিলাম আমার অবস্থান থেকে কিছু একটা করার। সেই চেষ্টা থেকেই ‘আওয়াজ উডা’। লেখা শুরু করার পর অটোমেটিক গানের কথাগুলো চলে আসছিল। মাত্র আড়াই ঘণ্টায় লিখেছিলাম গানটি।’

হান্নানকে ২৫ জুলাই গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হান্নানের গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবাদ করেন শিল্পী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। ১৩ দিন কারাগারে থাকার পর ৬ আগস্ট মুক্ত হন হান্নান।

মুহাম্মদ সেজানের ‘কথা ক’ গানটিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। গানটি প্রকাশ হয় জুলাইয়ের ১৬ তারিখে। প্রকাশের পর থেকেই দেশ-বিদেশে হাজার হাজার শেয়ার হতে থাকে। বিপ্লবী ডাক দেওয়া এমন গান যেন আগে কেউ শোনেনি! কয়েক দিনের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে হাজার প্রশ্নে এ গান প্রশাসনকে বিদ্ধ করতে থাকে। শোকার্ত শিক্ষার্থীরা যেন আবার উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পায়, ‘দ্যাশটা বলে স্বাধীন তাইলে খ্যাচ টা কই রে? কথা ক, আমার ভাই বইন মরে রাস্তায় তর চেষ্টা কইরে? কথা ক, কালসাপ ধরসে গলা পেঁচায়, বাইর কর সাপের

মাথা কো? ৫২ র তে ২৪ এ তফাত কই রে? কথা ক।’

সেজান জানান, জেদ থেকেই আমি ‘কথা ক’ গানটি লিখেছি। যে কোনো মানুষের দাবি থাকতেই পারে। সেটা নিয়ে যদি অত্যাচার করা হয়, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা কোথায়? আমাকে কারাগারে যেতে না হলেও বিভিন্ন মহল থেকে চাপের মুখে পড়েছিলাম। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, গান প্রকাশের পর থেকে চাপ আসতে পারে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে চুপ থাকতে পারিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে নির্মাণ করা র‌্যাপ গানের কয়েকটিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে বলতে হলে, ‘আওয়াজ উডা’, ‘দেশ সংস্কার, ‘গদি ছাড়’ গানের কথা উল্লেখ করা যায়। গানের মধ্যে এভাবে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ব্যবহার করে একটা বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে যে, শেখ হাসিনার সরকার যেই বঙ্গবন্ধুকে আদর্শ হিসেবে প্রচার করে এসেছে, সেটি ছিল শুধুই ঠকবাজি। এ ছাড়া এএস অমির ‘রক্ত’ গানে শেখ হাসিনার কয়েকটি ভাষণ যুক্ত করা হয়েছে। সেখানেও সরকারের বক্তব্যকে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে, বাতিল করে প্রচার করা হয়েছে প্রতিবাদী ভাষা। এএস অমি বলেন, ‘আবু সাঈদের মৃত্যুর পরই গানটি তৈরির চেষ্টা করি। সেদিন ছিল ১৬ জুলাই। রাত তিনটার মধ্যে গান কমপ্লিট হয়ে যায়। খুব কম সময়েই তৈরি করেছি। ১৮ তারিখ ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ জন্য গানটি প্রকাশ করতে পারিনি সে সময়। এরপর ২৬ তারিখ ইউটিউবে প্রকাশ করি। গান প্রকাশের পর থেকেই আমার বাসায় ফোনে হুমকি দেওয়া হয়। আমাদের টিম মেম্বার মাহির বাসায় পুলিশ যায়। ও বাসা ছেড়ে চলে যায়। আমি আমার বাসায় থাকতে পারিনি। আমিও বাসা ছেড়ে মামার বাসায় চলে আসি। র‌্যাপার হান্নানকে তো ধরেই নিয়ে যাওয়া হলো। আমাকে থ্রেট দেওয়া হয়েছে, ছাত্রলীগও হুমকি দেয়, পুলিশও আসে। এলাকার সবাই বলেছে, এই গানের জন্য আমাকে গুম করে ফেলা হবে। অন্য টিম মেম্বার শিশিরের বাসায় রাতে অ্যাটাক করা হয়, সেও পালিয়ে চলে যায়। ইশরাকের বাসাতেও হুমকি দেওয়া হয়। দেশের বড় বড় শিল্পীরা মুখ খোলেনি। তখন সবাই ভয় পেত। কার না কি হয়ে যায়, আর আমরা যারা ছোট শিল্পীরা আছি, ন্যায়ের কথা বলেছি, বড় বড় শিল্পীরা যা বলতে পারে নাই। এ জন্য মানুষ আমাদের ভালোবাসছে, মানুষ আমাদের স্যালুট জানাইছে। কিন্তু আমরা ভোগান্তিতে পড়েছি।’

৩০ জুলাই প্রকাশ হয় ‘চব্বিশের গেরিলা’। গানটিতে প্রশ্ন তোলা হয়, ‘আমরাই যখন রাজাকার, তাইলে ক তুই রাজা কার? জবাব চাই আমার ভাই মরলো ক্যান ক?’ এ সময়ের মধ্যে আরও অনেক র‌্যাপ গান প্রকাশ হয়। এসব গানে ১৫ বছরে যেসব অত্যাচার, অনিয়ম হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়েছে সরকারকে। স্বৈরাচারী সরকারের ভিত নড়বড়ে করে দেওয়া হয়েছে।