সারাজীবন মানবতার সেবা করতে চাই

তারেক আনন্দ
১৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
সারাজীবন মানবতার সেবা করতে চাই

কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপা। দীর্ঘদিন তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সব প্রোগ্রামে হয়েছেন বঞ্চিত। এমনকি সারাদেশের স্টেজ প্রোগ্রামও করতে দেওয়া হয়নি তাকে। ছাত্র-জনতার বিজয় হয়েছে। দেশে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জনপ্রিয় এই কণ্ঠশিল্পীর সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা

হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- তারেক আনন্দ

রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে আপনাকে বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্লক করা হয়েছিল। এ বিষয়গুলো ভাবতে এখন কেমন লাগছে?

রাজনৈতিক পরিচয়ে আমাকে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল পুরো ৭ বছর। অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি মহামারী করোনা আমাকে অনেক শিক্ষা দিয়েছিল। আমি বুঝেছিলাম অনেক কাপড় না থাকলেও বাঁচা যায়। অনেক খাবার, বিলাসিতা খুবই অন্যায় এবং নিবিড়ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শান্তিই সত্যিকারের শান্তি। ঠিক তেমনি এই যে আমার শিল্পী সত্তাকে আটকে দিল তাতে আমার অনেক উপকার হয়েছে। জন্মের পর থেকেই গানের সঙ্গে বেড়ে উঠেছি, নিজেকে দেখার ফুরসত আমার হয়নি বলা চলে। কী কী গান গেয়ে ফেলেছি, তা গাওয়া আসলে দরকার ছিল কি না তাও ভাবার সময় পাইনি। সত্যিকার অর্থে কিছু ভাবার, কিছু শোনার সময় পেয়েছি বিভিন্ন জার্নির ফ্লাইটে। ফ্লাইটে আমি পরিবারের সবার কাছে চেয়ে নিয়ে তাদের লেখা চিঠি পড়তাম, মনিটরে কোরআন মজিদ তেলাওয়াত শুনতাম। ভালো ভালো মুভি দেখতাম। বাস্তব জীবনে আমার কোনো ব্যক্তিগত সময়ই ছিল না। তো এই নিষিদ্ধ হওয়া সময়ে আমি অনেক মূল্যবান বই পড়েছি। কোরআন মজিদের বাংলা অনুবাদ অনুধাবনের চেষ্টা করেছি। রান্না আমার প্যাশন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে কনকচাঁপার পাকঘর ইউটিউব চ্যানেল খুলেছি। এবং সেখানে রান্নার ফাঁকে আমার প্রিয় ভক্ত-অনুসারীদের সঙ্গে একান্ত প্রিয় গল্প বলার সুযোগ পেয়েছি। বগুড়া একটা গ্রামে নিভৃতে  বসবাসের সুযোগ পেয়েছি। ছোট একটা জীবন। আল্লাহ ছাড়া কে এমন শক্তি রাখে আমার সময়কে আটকে রাখে। গান যা গাওয়ার তা গেয়ে ফেলেছি। এখন আমাকে আটকে লাভ? আমার গান আকাশে-বাতাসে ভাসে। কোনো টিভি চ্যানেলে বাজলেই কী না বাজলেই কী! জীবনে কখনো অসুস্থ ইঁদুর দৌড়ে দৌড়াইনি আলহামদুলিল্লাহ। তাই এতটুকু আত্মবিশ্বাস আছে, মানুষ আমাকে ভোলেনি বরং আরও বেশি করে মনে রেখেছে। এই ফাঁকে মায়ের যত্ন বেশি করে নেওয়ায় মন দিয়েছি। স্বামী-সন্তানদের সময় দিয়েছি। সেদিক থেকে এই বন্দিজীবন আমাকে আরও ঋদ্ধ করেছে আলহামদুলিল্লাহ।

সারাদেশের মানুষের প্রিয় শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও আপনার সঙ্গে যা যা ঘটেছে তা নিশ্চয়ই অনেক পীড়া দেয়?

দেশ আমাকে সারাজীবনই অবহেলা করেছে। বড় বড় স্টেজ প্রোগ্রামে আমি খুবই কম ডাক পেয়েছি। জীবনে একবারও সরকারি সফরে ডাকা হয়নি। এগুলোতে আমি অভ্যস্ত। জাতীয় পুরস্কারের জুরি বোর্ড জানে, জাতীয় পুরস্কার থেকে আমাকে কতবার বঞ্চিত করা হয়েছে। যদিও আমি তিনবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি কিন্তু দর্শক জানে কতগুলো গানে আমাকে তারা পুরস্কার পাওয়া থেকে বঞ্চিত রেখেছে। আফসোস নেই। ইদানীং এই পুরস্কার এত নিচে নেমেছে যে, আমি পাইনি বলে উল্টো আনন্দিতই হয়েছি। মানুষ বুঝেছে কনকচাঁপা পায়ে ধরে, ঘটনা সাজিয়ে পুরস্কার নেয়নি আজীবন। সরকারি (সে যে সরকারই হোক) অনুষ্ঠানে ঘন ঘন উপস্থিত থাকা শিল্পীদের মতো আমি নই। আমি অবশ্যই তাদের থেকে আলাদা। বড় কোনো অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে জায়গা ফাঁকা থাকলেও আমি কখনো সেখানে গিয়ে বসিনি। আমার অভ্যাস বলেন, ভদ্রতা বলেন, পারিবারিক শিক্ষা বলেন সবই এমন। আমি আমার পরিবারের দেয়া আঘাত বা পীড়া ছাড়া আর কারও পীড়া আমার কাছেধারে আসার অনুমতি দেই না। আমি যেমন নরম, তেমন শক্ত। বরং যারা এ খেলা খেলে তাদের অবলীলায় করুণা করার স্পর্ধা আমার আছে। মানুষের দেওয়া ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভালোবাসাই আমার শক্তি। আলহামদুলিল্লাহ। আর সব প্রশংসা আল্লাহতায়ালার।

No photo description available.

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশে এখন নতুন সরকার। তাদের এই বিজয় কীভাবে দেখছেন?

আল্লাহর পর বরাবরই আমার সব ভরসা যুব সম্প্রদায়ের ওপর। তারাই শক্তি, তারাই বল। অকুতোভয়, অনন্যসাধারণ। দেখিয়ে দিল তারা ঘুমায় না। মধ্যবয়সী মানুষ সহ্য করতে করতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও দম আটকে তারা চুপ থেকেছে। কিন্তু যুব সম্প্রদায় দেখিয়ে দিল যে, অন্যায় সহ্য করাও অপরাধ। আমি সামাজিক মাধ্যমে বারবার বলতাম, রাত যত গভীর হয় ভোর তত কাছে আসে। সত্যিই তারা একটা নতুন ভোর এনে দিল জীবন দিয়ে! আজকাল রুগ্ন ব্যক্তির সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে রক্ত পাওয়া যেখানে কঠিন, সেখানে তারা অকাতরে পুরো জীবনের রক্ত দেশের স্বার্থে পুরোটাই ঢেলে দিল রাজপথে! কান্না পায়, শুধু কান্না। তারা দেখিয়ে দিল কীভাবে ভয়কে জয় করতে হয়, শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হয়। আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দিন। এই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া সব তরুণের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং তাদের প্রতি এতটাই শ্রদ্ধা জানাই, যেমন শ্রদ্ধা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যারা শহীদ হয়েছেন এবং বেঁচে আছেন।

রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ইচ্ছার কথা জানতে চাই।

আমি মানবতার সেবা করে যাব, যেভাবে সারাজীবন করেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই। রাজনৈতিক পটভূমি অনেক বড় জায়গা। এখানে কাজ করার মতো অথবা তার চেয়েও বেশি সততা, ভালোবাসা আমার আছে কিন্তু আমি রাজনৈতিকমনস্ক মানুষ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নই। আমি বুঝতে পেরেছি একজন দুঁদে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কতটা জ্ঞান রাখেন। আমি মূর্খের মতো কাজ করতে চাই না। এই বিষয়ে বিশদ পড়াশোনা করা দরকার। আবার বলছি, মানবতার সেবা করেই যাব, যেমন করে গেছি আজীবন। আমি ভুলে গিয়েছিলাম জনসেবা আর মানবসেবার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। কখনো মন্ত্রী-এমপি হওয়ার স্বপ্ন দেখিনি। কিন্তু প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একটা প্রসেসের ভেতর দিয়ে যেতে হয় বলে আমাকে কারও ছায়াতলে দাঁড়াতে হয়েছে। কখনো সেই রকম রাজনীতি করতে চাইনি, যে রাজনীতিতে ভালোবাসার উল্টো পিঠে জমে থাকা এক আকাশ ক্ষোভ আর সাগরসম ঘৃণা। আজ দুই ভাগ হয়ে গেছি। আমাকে আমার দেশের মানুষ চিনতে পারল না ঠিকভাবে। এটাই সবচেয়ে বড় দুঃখ। তারা ভাবল ক্ষমতা ও অর্থের লোভ অন্যদের মতো আমার ভেতরেও কাজ করছে। দুই ভাগ হতে চাই না, পুরোপুরি বাংলাদেশের কনকচাঁপা হতে চাই। আমি মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে মানুষের সেবা করব। এবার মেঘ হতে চাই, যে মেঘে বৃষ্টি ঝরে, ফসল ফলে। তার পরও সাধারণ মানুষ যদি আমাকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চান তখন আমি আমার সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তা পালন করতে চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

No photo description available.

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে একজন কনকচাঁপার প্রত্যাশার কথা জানতে চাই।

দেশের কাছে, নতুন গঠিত সরকারের কাছে আমার একটাই চাওয়া মিথ্যাচারমুক্ত বাংলাদেশ। কারণ মিথ্যাচারই সব পাপের মা। কেউ যখন মিথ্যা বলবে না, নিজ তাগিদে তখন খারাপ কাজ করতে পারবে না। একজন চোরকে চুরি করতে যাওয়ার সময় যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কোথায় যাওয়া হচ্ছে? তখন সে যদি সত্যবাদী হয় (হোক সে চোর) তখন কি লজ্জা ভেঙে বলতে পারবে আমি চুরি করতে যাচ্ছি? নতুন সরকারের কাছে দ্রব্যমূল্য সহনশীল থাকা, আয়ের শুরুতেই উপযুক্ত ট্যাক্স অটোমেটিক কেটে রাখা। ঘুষের কোনো জায়গা না থাকা। রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি বন্ধের আশা করার সঙ্গে একটা স্বপ্ন খুব দেখি আর তা হলো আমাদের দেশের ভিআইপিরা যেমন একটা সম্মানিত লাউঞ্জ ব্যবহার করেন, তেমনই আলাদা একটা লাউঞ্জ তৈরি করে দিতে হবে আমাদের প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য। বৃদ্ধদের জন্য বরাদ্দ ভাতা যেন বৃদ্ধরাই পান। সব ধর্মমতের মানুষ যেন তাদের পরিপূর্ণ অধিকার নিয়ে এই দেশে বাস করতে পারে নিশ্চিন্তে। আমি আরও চাই সুবিধাবঞ্চিত শিশু, সংখ্যালঘু উপজাতি শব্দগুলো আমাদের অভিধান থেকে, ভাষা প্রায়োগিক দিক থেকে একদম উঠে যাক। আর প্রতিটি স্কুল-কলেজে প্রয়োজনমতো, স্বস্তির সঙ্গে ব্যবহার করার মতো বাথরুম থাকবে। থাকবে সাবান এবং স্যানিটারি টাওয়েল। আল্লাহ আমাদের আশাগুলো পূর্ণ করুন।