নতুন সরকারের যাত্রা শুভ হোক

আবুল মোমেন
০৯ আগস্ট ২০২৪, ২০:৩৬
শেয়ার :
নতুন সরকারের যাত্রা শুভ হোক

নোবেলজয়ী বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বহু প্রতীক্ষিত ও বহু আকাঙ্ক্ষিত অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হলো। সকলেই জানি ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের শাসনকালের অবসান হয়েছে গত ৫ আগস্ট। বাংলাদেশে ইতিপূর্বে স্বৈরাচার আখ্যায়িত হয়ে এরশাদ সরকারের পতন ঘটেছিল ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনের মাধ্যমে। সেবার ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনগুলো এ আন্দোলনের সম্মুখ কাতারে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করলেও তিন জোটের মাধ্যমে আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব ছিল দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে। ফলে সেবার পটপরিবর্তনের পরেও গতানুগতিক রাজনৈতিক ধারাই ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল। এবারের গণ-আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং তা পরিচালনায় কেবল ছাত্র-তরুণরাই যুক্ত ছিল। তারা আন্দোলনের লাগাম এখনো নিজেদের হাতে রেখেছে। এ পরিবর্তনকে ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সেই বিপ্লবের মূল স্লোগান ছিল সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা; তাদের মূল লক্ষ্য ছিল পুরনো ব্যবস্থা (ancient regime) বাতিল করে নতুন ব্যবস্থার প্রবর্তন। আমাদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করাও বারবার বলছেন তাঁরা একটি সরকারের পতন শুধু নয়, রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমন সংস্কার চান, যাতে পুরনো ব্যবস্থা ফিরে না আসে, যেন দেশে নির্বাচনের মাধ্যমেও কোনো স্বৈরশাসকের আবির্ভাব ঘটতে না পারে। তাদের এই অঙ্গীকার মানুষের মনে আশাবাদ সৃষ্টি করছে। কারণ অতীতে বারবার সরকার পতন সত্ত্বেও জবাবদিহিতাবিহীন, চরম ক্ষমতালোভী কর্তৃত্ববাদী সরকারেরই উদ্ভব ঘটেছিল। এ থেকে বেরিয়ে আসাই ছাত্র-তরুণ এবং জাতির আজকের আকাঙ্ক্ষা।

এই বিশাল কর্মযজ্ঞের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে ছাত্র-তরুণরা যোগ্য ব্যক্তিকেই বেছে নিয়েছে। তাঁর বয়স হলেও ড. ইউনূস অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ মানুষ, তাঁর কর্মস্পৃহা ও নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতাও পরীক্ষিত। ইতিমধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর সহকর্মীদের বেছে নিয়েছেন। জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে তাঁরা তাঁদের কাজ শুরু করেছেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও মন্ত্রিসভার দপ্তর বণ্টন করা হয়েছে। আশা করা যায় যে তিনজন উপদেষ্টা এখনো শপথ নিতে পারেননি তাঁরা অবিলম্বে সরকারে যুক্ত হবেন এবং সরকার পূর্ণ শক্তিতে কাজ শুরু করবে। এও প্রত্যাশা থাকবে যে আগামী সপ্তাহের শুরু থেকেই সচিবালয়সহ প্রশাসনের সর্বত্র কর্মচাঞ্চল্য শুরু হবে। আমরা নতুন সরকারকে অভিনন্দন এবং তাঁদের সাফল্যের জন্যে শুভকামনা জানাই। সেই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেব যে-ক্রান্তিকালে তাঁরা দেশকে নতুন পথে পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তা নির্মাণে বহু ছাত্র, তরুণ ও জনতা প্রাণ দিয়েছেন। কেবল তাঁরাই নন এ সময় বহু পুলিশ সদস্যও প্রাণ হারান এবং রাষ্ট্রের বহু সম্পদও ধ্বংস হয়েছে। এই সরকারকে নিহত-আহতদের বিষয়ে যেমন সহানুভূতিশীল হতে হবে তেমনি এসব ঘটনার জন্যে দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায়ও আনতে হবে।

কোনো সন্দেহ নেই যে নতুন সরকারের সামনে কঠিন পথ, তবে তাঁদের পেছনে রয়েছে ব্যাপক মানুষের সমর্থন। আশা করি তাঁরা বিভাজনের পথ থেকে জাতিকে সমঝোতা ও ঐক্যের পথে আনার কাজ করবেন। কারণ বিভাজিত জাতি বারবার সংঘাত, সহিংসতায় জড়িয়ে যায়। তাতে কেবল রাজনৈতিক অঙ্গন নয় অর্থনীতিসহ সামাজিক অঙ্গনেও অস্থিরতা, অবক্ষয় দেখা দেয়, সার্বিক উন্নয়ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। গত কয়েকদিনে দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অবিলম্বে তা কাটিয়ে ওঠার জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৭ জনের এই উপদেষ্টা পরিষদে সরাসরি রাজনৈতিক দলের সদস্য কেউ নেই। তাঁদের কারো মনে ব্যক্তিগতভাবে যে চিন্তাই থাকুক না কেন এখন সরকারের দায়িত্ব নিয়ে শপথ বাক্যে উচ্চারিত প্রতিশ্রুতির কথাই সকলকে মনে রাখতে হবে। কোনো রাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ না করার বিষয়ে তাঁরা সংবিধানসম্মতভাবে দায়বদ্ধ। মনে রাখতে হবে বিপুল প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের পরে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে চলমান অরাজক অবস্থায় মানুষ অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। নতুন সরকারের প্রথম দায় হবে সারাদেশে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে জনমনে এবং জনজীবনে স্বস্তি ও নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনা। আশা করি সরকার জরুরিভিত্তিতে সর্বশক্তি দিয়ে এ কাজটি সর্বাগ্রে করবেন।

আশার কথা আন্দোলনের অংশীদার ছাত্র-তরুণরা সাধ্যমত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। তারা ট্রাফিক সামলানোর মতো কাজেও হাত লাগাচ্ছেন, তাদের কেউ কেউ রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন রাখার কাজও করছেন। তাদের এ আন্তরিক দেশপ্রেমিক ভূমিকাকে অভিনন্দন জানিয়েও বলব, সাড়ে সতের কোটি মানুষের দেশে যে কাজ নৈমিত্তিকভাবে করতে হয় তা কেবল স্বেচ্ছাসেবীদের তৎপরতায় দীর্ঘমেয়াদে চালানো যায় না। তাদের উপস্থিতি ও কাজে অংশগ্রহণ সংশ্লিষ্ট কর্মীদের প্রতি একধরনের ইতিবাচক বার্তা দেবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম কাজ শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা হলেও তাঁদের মূল কাজ কিন্তু একটি অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান। তবে এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হবে আন্দোলনকারীরা শাসনব্যবস্থায় যে কাঠামোগত পরিবর্তনের শর্ত যুক্ত করেছে সেটা। তাদের দাবির যৌক্তিতা স্পষ্ট। আমাদের এতকালের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা আদতে কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতাদর্পী স্বৈরশাসক তৈরি করেছে। সুষ্ঠু বা ত্রুটিপূর্ণ যেভাবেই নির্বাচন হোক না কেন শাসকের উত্থান ঘটেছে একই ফর্মুলায়। শাসন কাজে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স প্রতিষ্ঠায়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে, বিভিন্ন দল ও মতের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির জন্যে হয়তো সংবিধানেও কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে। এ কাজ প্রথমত, সময়সাপেক্ষ, দ্বিতীয়ত রুটিন কজের বাইরে এ ধরনের নীতি-সংস্কারের জন্যে সংবিধান সংশোধনের মতো কাজ কি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করতে পারে? আমাদের মনে হয় জনগণের প্রত্যাশা, দেশের প্রয়োজন এবং সংবিধানের দিকনির্দেশনা মাথায় রেখেই সরকারকে কাজ করতে হবে। তাঁদের হাতে সময় কতটা থাকবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এটুকু বলা যায় দ্রুততার সাথেই অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ হলে সবার মঙ্গল হবে। তাই বলব, সরকারকে যথেষ্ট সময় দেওয়া দরকার বটে, তবে তা অতি দীর্ঘ হওয়ায়ও উচিত হবে না। মোট কথা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর সাথীদের বেশ কিছু কঠিন কাজ কম সময়ে সম্পাদন করতে হবে। ইতিহাস তাঁদের সামনে এই চ্যালেঞ্জ রেখেছে।

লেখক: আমাদের সময়ের সম্পাদক