‘গুলিতে মাথার মগজ উড়ে যায় ফয়সালের’

দেবিদ্বার (কুমিল্লা) প্রতিনিধি
০২ আগস্ট ২০২৪, ১৬:১৩
শেয়ার :
‘গুলিতে মাথার মগজ উড়ে যায় ফয়সালের’

ধবধবে একটি সাদা ব্যান্ডেজের ওপর লেখা, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না’। এমন একটি ছবি হাতে নিয়ে বুক চাপরে বিলাপ করছেন নিহত ফয়সালের বৃদ্ধা মা হাজেরা বেগম। তার আত্মচিৎকারের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। পাশে বসে কাঁদছেন ফয়সালের বাবাসহ তার ছয় বোন ও আত্মীয়স্বজন।

আজ শুক্রবার বেলা ১১ টায় সংবাদমাধ্যম কর্মীদের দেখে ফয়সালের মা হাজেরা বেগম বলছেন, ‘আমার ছেলের জীবনডারে কেউ ভিক্ষা দাও, আহারে আমার নিমাইরে এমনভাবে গুলি করছে যে মাথা মগজও উড়ে গেছে। কোন পাষণ্ড আমার ছেলেরে এমনে গুলি করল, তার কি একটু হাত কাঁপল না।’

তিনি আরও বলেন,‘পোলারে কত জায়গায় খুঁজছি, কেউ বলতে পারেনি কই আছে, থানায় গিছি, এই হাসপাতালে, ওই হাসপাতালে ঘুরছি, কোথাও পাইনি, ১৩ দিন পর জানছি, আমার ছেলেরে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করছে, আমার মানিক চানরে কই দাফন করছে তাও কেউ জানে না। কবরে দাঁড়াইয়া যে ফয়সাল বইল্ল্যা ডাক দেমু তাও পারমু না, আহারে ফয়সালরে তুই কই গিয়া শুইয়্যা আছত, আমার বুকে আয় বাবা।’

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর এলাকায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ফয়সাল সরকার। ঘটনাটি গত ১৯ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যার। পরে ২২ জুলাই থেকে ২৫ জুলাইয়ের কোনো এক সময় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে ফয়সালকে ঢাকায় কবর দেওয়া হয়। পরে ১ আগস্ট পরিবারের লোকজন জানতে পারেন ফয়সালকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়।

নিহত ফয়সাল সরকার কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ ইউনিয়নের কাচিসাইর গ্রামের সরকার বাড়ির মো.সফিকুল ইসলাম সরকারের ছেলে।তিনি চলতি বছরে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। ইতোমধ্যে আট বিষয়ে পরীক্ষা শেষ করেছেন। পাশাপাশি সংসারের অভাব ঘুচাতে শ্যামলী পরিবহণের একটি বাসে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতেন। বাবা-মা, ভাইসহ পরিবার নিয়ে থাকতেন আব্দুল্লাহপুর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায়। 

নিহত ফয়সালের ছোট ভাই ফাহাদ সরকার বলেন, ‘গত ১৯ জুলাই বিকেলে আব্দুল্লাহপুরের শ্যামলী পরিবহণের কাউন্টারে যাবেন বলে বাসা থেকে বের হয় ফয়সাল। সন্ধ্যার পর ভাইয়ের নম্বরের ফোন করলে নম্বর বন্ধ পাই। এরপর আমরা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুজি শুরু করি। বাহিরে তখনও গোলাগুলি চলছিল। কোথাও খোঁজ না পেয়ে ২৮ জুলাই দক্ষিণ খান থানায় জিডি করি। গত ১২দিন ঢাকার এই হাসপাতালে ওই হাসপাতালে খোঁজাখুজি করেছি, কোথাও হদিস পাইনি। পরে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে খোঁজ নিলে তারা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা মরদেহগুলোর ছবি দেখালে সেখানে ফয়সাল ভাইয়ের মরদেহের ছবি দেখতে পাই। কোথায় দাফন করা হয়েছে জানতে চাইলে তারা জানায়, ১৫/২০টি লাশ একবারে গণকবর দেওয়া হয়েছে, কাকে কোথায় দাফন করা হয়েছে তারা তা জানেন না।’

ফয়সালের বড় বোন রোজিনা আক্তার ও নুরুননাহার আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমাদের ছয় বোনের পর এই ভাই, আপনারা আমার ভাইকে এনে দেন, আমরা কোনো রাজনীতি করি না, আমাদের সংসার এখন কে চালাবে, আমাদের কি হবে। এই ভাই রোজগার করে বোনদের বিয়ে দিয়েছে। আমার বাবা কানে শুনে না।’

নিহত ফয়সালের বাবা বৃদ্ধ মো. সফিকুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘আমার ছয় মেয়ের পর ফয়সাল হইছে। এই ফয়সাল লেখাপড়ার পাশাপাশি শ্যামলী বাসে পার্টটাইম সুপারভাইজারের কাজ করে সংসার চালাত। এখন আমার পুরো সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই। কারা আমার ছেলেকে হত্যা করল। কী দোষ ছিল আমার ছেলের, সে তো কোনো রাজনীতি করত না, পেটের দায়ে বাসে কাজ করত, তাকে কেন গুলি করে মারা হলো ? এই বিচার আমি কার কাছে দেব?’ 

দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নিগার সুলতানা বলেন, ‘১৩ দিন পর ফয়সালের মৃত্যুর খবরটি জানতে পেরেছি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। এর আগেও ঢাকায় নিহত কয়েকজনের বাড়িতে আমি গিয়েছি, সহযোগিতা করেছি। ফয়সালের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হবে, সরকারিভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।’