মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন সুমন

দিশেহারা পরিবার

আজাদুল আদনান
২৮ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন সুমন

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তীব্র সংঘর্ষ শুরু হলে আতঙ্কে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঘরেই ছিলেন হকার মো. সুমন মিয়া (৩৮)। দুপুরে রাস্তার পাশে তার টংদোকানের জামা-কাপড় ঠিক আছে কিনা দেখতে যান। কিন্তু এতেই সর্বনাশ ঘটে তার। হঠাৎ ইট এসে পড়ে সুমনের মাথায়। ইটের আঘাতে মাথার খুলি ভেঙে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। শুরুতে স্থানীয় একটি হাসপাতালে, পরে ঢাকায় আনা হয় তাকে। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে সুমন এখন হাসপাতালের বিছানায় অনেকটা

মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায়। আর পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তির এমন দশায় দুই সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা তার স্ত্রী আমেনা আক্তার ইভা।

গত ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় এই সহিংস ঘটনার শিকার হন হকার সুমন মিয়া। বর্তমানে রাজধানীর জাতীয় নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চাষাঢ়ার গলাচিপা মহল্লায় পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছেন তিনি।

পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই গলাচিপার কাছে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছিল। বাসা থেকে দোকানের দূরত্ব পাঁচ মিনিটের। সংঘর্ষের ফলে আয়ের একমাত্র উৎস রাস্তার পাশের টংদোকান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন আশঙ্কায় ঝুঁকি নিয়েই দোকানের দিকে গিয়েছিলেন সুমন।

গতকাল শনিবার নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালের গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির নিউরোট্রমা বিভাগের ওয়ার্ডে শুয়ে আছেন সুমন। অস্ত্রোপচারের ফলে মাথায় ব্যান্ডেজ। ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। যতটুকু বলেন, তাও অনেকটা ভুলভাল। কমেছে স্মৃতিশক্তিও। গত এক সপ্তাহ ধরে স্যালাইনের ওপর রাখা হয়েছে। এক মাস পর দ্বিতীয় দফায় ভাঙা হাড় জোড়া লাগানো হবে। কবে নাগাদ পূর্ণ সুস্থ হবেন নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না চিকিৎসকরা।

সুমনের স্ত্রী ইভা আমাদের সময়কে বলেন, ‘প্রতিদিনের রোজগারের ওপর আমাদের সংসার চলে। দোকান ঠিক না থাকলে পথে বসতে হবে। তাই সেটি ঠিক আছে কিনা তা দেখতে গিয়েছিল স্বামী। কিন্তু অবস্থা যে এমন হবে তা কল্পনাও করতে পারিনি। দোকানের দিকে যাওয়ার পর পর কয়েকটা ইট মাথায় এসে পড়ে। এতে মাথার হার ভেঙে গেলে প্রচুর রক্ত ঝরে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে দুই শিক্ষার্থী তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে জেলার পপুলার হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু অবস্থা গুরুতর দেখে ঢাকায় আনার তাগাদা দেন চিকিৎসক। এখন কথা কম বলে। আবার যতটুকু বলে উল্টোপাল্টা জবাব দেয়। স্মৃতিশক্তিও আগের মতো নেই।’

ইভা বলেন, ‘ঢাকায় নিয়ে আসার মতো পরিস্থিতি ছিল না। কারণ, কারফিউয়ের কারণে অ্যাম্বুলেন্স আসতে রাজি নয়। পরে প্রাণ বাঁচাতে অনেক টাকা ভাড়া দিয়ে ঝুঁকি নিয়েই আনতে হয়েছে। পথে পুলিশ, আর্মি কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে। চিকিৎসকরা বলছেন, হাড় দেড় ইঞ্চি পরিমাণ ভেতরে দেবে গেছে। সার্জারি করে জোড়া লাগানো হবে। এ জন্য এক মাস অপেক্ষা করতে হবে।’

চিকিৎসার খরচ মেটাচ্ছেন কীভাবে জানতে চাইলে সুমনের স্ত্রী বলেন, ‘এগুলো আর জিজ্ঞেস করে কী হবে ভাই? আমরা গরিব মানুষ। আমাদের কথা কেউ ভাবে না। ঘরের একমাত্র কর্তা এখন হাসপাতালের বিছানায়। দুই সন্তান একজনের বয়স ১২, অন্য জনের ৮ বছর। তাদের নিয়ে কীভাবে বাঁচব কিছুই জানি না। দিন আনি দিন খাই। চিকিৎসা যে ঠিকমতো করব সেটারও উপায় নেই। সরকারি হাসপাতালে খরচ কম। তারপরও অপারেশন, প্রতিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধের পেছনে সব মিলিয়ে প্রায় অর্ধলাখ টাকা চলে গেছে। নানা জনের কাছ থেকে ধারদেনা করে স্বামীর চিকিৎসা করাচ্ছি। হকারগিরি করে এত টাকা কীভাবে মেটাই?’

প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের চাপ কিংবা হুমকি পাচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে ইভা বলেন, ‘এখনো ওই ধরনের চাপ পাইনি। তবে পরিচয় না দিয়ে একজন লোক সব নাম, ঠিকানা নিয়ে গেছে। ওই সময় কী হয়েছিল, কেন গেছে নানা বিষয় জিজ্ঞেস করেছে।’