যাদের আত্মত্যাগের কথা বলা হয় না, তাদের গল্প নিয়ে রাকিবুল হাসানের ‘ছোঁয়া’

বিনোদন প্রতিবেদক
০২ জুলাই ২০২৪, ২০:৪৮
শেয়ার :
যাদের আত্মত্যাগের কথা বলা হয় না, তাদের গল্প নিয়ে রাকিবুল হাসানের ‘ছোঁয়া’

রাকিবুল হাসান; একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, সিনেমাটোগ্রাফার ও শিক্ষক। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাস কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগে পড়াতেন ২০১১ সাল থেকে। বর্তমানে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগে পড়ান। বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দুই মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন।

রাকিবুল হাসান চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় তিন দশক ধরে। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘হাজারিবাগ ইন শটস’ নির্মাণ করেছিলেন ১৬ মি.মি. ফিল্মে, ১৯৯৬ সালে। ৩৫ মি.মি. ফরম্যাটে নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘লিলিপুটরা বড় হবে’ মুক্তি পায় ২০০৮ সালে। এরপর তিনি নির্মাণ করেন ‘হিল্লা’ এবং ‘নারী’ নামে আরও দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এরই মাঝে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের জন্য তিনি নির্মাণ করেছেন অর্ধ-শতাধিক নাটক, টেলিফিল্ম ও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান। পাশাপাশি তিনি ধারাবাহিকভাবে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গেছেন। চলচ্চিত্র শিল্পে অবদানের জন্য ২০২৩ সালে পেয়েছেন ‘ঋত্বিক সম্মাননা পদক’।

 ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ছোঁয়া’ নির্মাণের জন্য তিনি সরকারি অনুদান পেয়েছেন । ‘ছোঁয়া’ তার চতুর্থ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। সম্প্রতি তিনি চলচ্চিত্রটি নির্মাণের প্রস্ততি নিচ্ছেন; চলছে অভিনয়শিল্পী ও লোকেশন নির্বাচনের কাজ।

 সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তার কাছে জানতে চাইলাম, ‘ছোঁয়া’র গল্পটি কেমন?

রাকিবুল হাসান বললেন, ‘ছোঁয়া’ চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় একটা কমিউনিটির সংগ্রামের একটি মর্মস্পর্শী চিত্র। চলচ্চিত্রটিতে চরিত্রদের ব্যক্তিগত গল্পের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, বৃহত্তর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়গুলিকে বাস্তববাদের গভীর অনুভূতির সাথে তুলে ধরা হবে।

চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য 'ছোঁয়া' গল্পটি কেন বেছে নিলেন?

রাকিবুল হাসান: আমাদের এই দেশটি নির্মানের জন্য যারা আত্মত্যাগ করেছিলেন, তাদেরকে নিয়ে বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সেসব চলচ্চিত্রে এখনও যাদের আত্মত্যাগের কথা বলা হয়নি, সেরকম একটা শ্রেণীর গল্প ‘ছোঁয়া’। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমাদের নতুন প্রজন্ম, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তারা জানবে, মুক্তিযুদ্ধে অবদান রয়েছে- সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও যেনও সঠিক ধারণা পায় ‘ছোঁয়া’তে সে চেষ্টাটাই থাকবে।

 আপনার ‘লিলিপুটরা বড় হবে’ চলচ্চিত্রটিওতো শ্রেণী বৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ করেছিলেন?

রাকিবুল হাসান: হ্যাঁ, ওই চলচ্চিত্রে আমি দেখিয়েছি, নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা ‘লিলিপুট’দের মত ক্ষুদ্র। শ্রেণী বৈষম্য দূর করার জন্য তাদের নিজেদেরই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, বড় হতে হবে। এবং ‘লিলিপুট’রা সত্যিই একদিন বড় হবে -এই আশাবাদ ব্যক্ত করে ছবিটি শেষ করেছিলাম।

 

আপনার ‘হিল্লা’ চলচ্চিত্রের গল্পটা কী ছিল?

রাকিবুল হাসান : ইসলামে কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার পর যদি আবার সেই স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে চায় তাহলে স্ত্রীকে আরেকজনের সাথে ‘হিল্লা’ বিয়ে দিতে হয়। এই ‘হিল্লা’ বিয়ে নিয়ে বিভিন্ন হাদিসের মধ্যে কন্ট্রাডিকশন রয়েছে। তাহলে, একজন মুসলিম কোন হাদিসটা গ্রহণ করবে? -এই প্রশ্নটা রেখেছিলাম ‘হিল্লা’ চলচ্চিত্রে।

 আর ‘নারী’ চলচ্চিত্রে?

রাকিবুল হাসান: দেশে যখন জঙ্গিবাদ বেড়ে গিয়েছিলো এবং জঙ্গিরা দেশে শরীয়া আইন চালুর দাবি তুলছিল, তখন ‘নারী’ চলচ্চিত্রে শরীয়া আইনের কুফলগুলো তুলে ধরা হয়েছিল।

ধর্মের নামে ক্ষতিকর কিছু করা হলেও কেউ প্রশ্ন তুলতে চায় না। আপনি কেন এগিয়ে এলেন?

রাকিবুল হাসান: দেখুন, আমার পায়ে ঘা হলে আমি যদি চিকিৎসা না করে তা ঢেকে রাখি তাহলে পায়ে পচন ধরে গ্যাংরিন হতে পারে। এমন কী, একসময় আমার পা কেটে ফেলতে হতে পারে। তাই, ঘা কে আমি প্রকাশ্যে আনতে চাই, যেনও সবাই ভাবতে পারে- এর চিকিৎসা দরকার।

আপনি তো প্রামাণ্য চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন, আপনার কাছে আপনার নির্মিত বিশেষ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র কোনটা?

রাকিবুল হাসান: দুটো প্রামাণ্য চলচ্চিত্র আমার কাছে বিশেষ- একটা ২০১৫ সালে সিরিজ ব্লগার হত্যাকান্ডের সময়ে নির্মিত ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’ এবং ‘কোভিড-১৯’ দুর্যোগের সময় ২০২০ সালে ঘরে বসে সারাবিশ্বে নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে নির্মিত ‘উইন্ডোজ ২০: লকডাউন এডিশন’।

 আপনি তো সিনেমাটোগ্রাফিও করেন। এর মধ্যে কী করলেন, কী করবেন?

রাকিবুল হাসান: জাহিদ হোসেন পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘সুবর্ণভূমি’ শেষ করেছি, আগস্ট থেকে তারই আরেকটা চলচ্চিত্র ‘লীলামন্থন’-এ সিনেমাটোগ্রাফি করব। ২০২৫-এর শুরুতে সিনেমাটোগ্রাফি করব তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ চলচ্চিত্রে। 

 তাহলে আপনার ‘ছোঁয়া’র শুটিং কবে শুরু হবে?

রাকিবুল হাসান: ‘ছোঁয়া’; ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকাল এবং ২০২২-২৩-এর কোভিড দুর্যোগকাল-এই দুই সময়ের গল্প। এই চলচ্চিত্রের সেটিংস হবে দুই ধরণের। তাই, আমি শুটিং করব দুই পার্টে। প্রথম পার্টের শুটিং নভেম্বরে শুরু করার কথা ভাবছি, দ্বিতীয় পার্ট ২০২৫-এ।

 আপনি কীভাবে চলচ্চিত্রকার হয়ে উঠলেন?

রাকিবুল হাসান: শৈশবে আমার জীবনের কোনো লক্ষ্য ছিল না, চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার কথাতো ভাবিইনি। লেখালেখি, সাংবাদিকতা, ফটোগ্রাফি করতাম। ‘কিশোর কথা’ নামে একটা কিশোর মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলাম ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত। ১৯৯০ সালে মঈনুল আহসান সাবেরের কিশোর উপন্যাস ‘লিলিপুটরা বড় হবে’ বইটি পড়ে আমার মনে হয় এটা নিয়ে একটা চলচ্চিত্র নির্মিত হতে পারে। তখন থেকেই চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার ভাবনাটা আমার মাথায় আসে এবং আমি পড়াশোনা, ওয়ার্কশপ এবং চলচ্চিত্র পাঠের মাধ্যমে নিজেকে ধীরে ধীরে তৈরি করতে থাকি।

 নিজেকে কীভাবে তৈরি করলেন?

রাকিবুল হাসান: ১৯৮৯ সালে আমি ‘বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক ইন্সটিটিউট’ থেকে ফটোগ্রাফি কোর্স সম্পন্ন করেছিলাম। এরপর ‘বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম’ আয়োজিত প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ কর্মশালা, ‘জাতীয় গণমাধ্যম ইন্সটিটিউট’ থেকে ‘টেলিভিশন প্রযোজনা কৌশল’ শীর্ষক কর্মশালা, ‘ওয়ার্ল্ডভিউ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন’ থেকে ‘এডুকেশনাল টিভি প্রোগ্রাম’ কোর্সসহ বহু কোর্স করেছি। চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়াশোনা, চলচ্চিত্র পাঠ, তাত্ত্বিকের পাশাপাশি কারিগরি জ্ঞানার্জনের জন্য বিভিন্ন প্রডাকশনের সাথে যুক্ত হই ইত্যাদি।

 ৮০-র দশকে আপনি লেখালেখি করতেন, এখনও কি করেন?

রাকিবুল হাসান: সম্প্রতি চারটা সেমিনারের জন্য প্রবন্ধ লিখেছি- ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর’-এর জন্য ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যুগে চলচ্চিত্র’, ‘বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ড’-এর জন্য ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে চলচ্চিত্র শিল্প ও বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ড-এর ভূমিকা’, ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি’র জন্য ‘আলমগীর কবির- বাংলাদেশী চলচ্চিত্র শিল্পের পথপ্রদর্শক’ এবং ‘তারেক মাসুদ একজন চলচ্চিত্র দুশ্চিন্তাবিদ’।

 সিনেমাটোগ্রাফির ওপরে আপনি একটা বই লিখেছেন, আর কিছু কি লিখছেন?

রাকিবুল হাসান: আমার ‘সিনেমাটোগ্রাফি তত্ত্ব এবং শিল্পরুপ’ বইটিকে পূর্ণতা দিতে লাইটিংয়ের ওপর একটা বই লিখছি। বইটা আগামি একুশে বইমেলায় পাবলিশ হতে পারে।

 কার চলচ্চিত্র আপনার সবচেয়ে প্রিয়?

রাকিবুল হাসান: আমার কোনো ‘পীর’ নেই। আমি তারকোভস্কি, গোদার, ত্রুফো, ব্রেঁস, ওজু, মিজোগুচি, কিয়ারোস্তমী, পোলনস্কি, কিম-কি-ইওং, ওসমান সেমবেন, গুরু দত্ত, ঋত্বিক, সত্যজিতের চলচ্চিত্র যেমন দেখি, তেমনি সমান গুরুত্ব দিয়ে এই সময়ের একজন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতার চলচ্চিত্রও দেখি। চলচ্চিত্র দেখার ক্ষেত্রে আমি ‘প্রি-জাজমেন্ট’ করি না।

 এই প্রজন্মের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের উদ্দেশে কিছু বলুন?

রাকিবুল হাসান: সবকিছু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে তাই, প্রতিনিয়ত নিজেকে ‘আপডেট’ করতে হবে। নিজেকে ‘আপডেট’ করতে গিয়ে আমরা যেনও নিজের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না যাই।

আবারও ‘ছোঁয়া’ প্রসঙ্গে আসি। দর্শকের মনস্তত্বে আপনার ‘ছোঁয়া’ চলচ্চিত্রটি কী মনোভাব সৃষ্টি করবে বলে আপনি মনে করেন?

রাকিবুল হাসান: ‘ছোঁয়া’ চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং সেই সময়ের ত্যাগ ও সংগ্রামের গল্প উঠে আসবে। এটি দর্শকদের মধ্যে ইতিহাসের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং দেশের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত করবে। ‘ছোঁয়া’ চলচ্চিত্রটি দর্শকদের মনস্তত্বে একটি গভীর এবং স্থায়ী প্রভাব ফেলবে। এটি শুধু একটি আবেগময় কাহিনী নয়, বরং একটি শিক্ষা, অনুপ্রেরণা এবং মানবিকতার প্রতীক হয়ে উঠবে। ‘ছোঁয়া’ চলচ্চিত্রটি দর্শকদের হৃদয়ে মমতা, সহানুভূতি, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার অনুভূতি সৃষ্টি করবে, যা তাদের জীবনে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়ক হবে বলে আমি আশাবাদী।