‘মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি’

রায়হান উদ্দিন, চট্টগ্রাম
২৮ জুন ২০২৪, ২১:৪১
শেয়ার :
‘মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি’

রাত দেড়টা। পরিবারের সবাই তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভেঙে যায়। মুহূর্তেই পুরো রুম আন্ধকারচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বাসা থেকে বের হওয়ার পথও দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছি। এভাবে বর্ণনা করছিলেন অগ্নি-দুর্ঘটনায় থেকে বেঁচে ফেরা মোহাম্মাদ রায়হান।

গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারের মোহাম্মদী প্লাজায় এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেখানে তিন সন্তান ও স্ত্রীকে বাঁচাতে দেড় ঘণ্টা যুদ্ধ করেন রায়হান। বর্তমানে দুই সন্তান সুস্থ থাকলেও স্ত্রী মেহরিনা পারভিন ও ৯ বছরের শিশু জান্নাতুল আক্তার সংকটাপন্ন হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

রায়হানের বাড়ি যশোর জেলার বেনাপোলে। কর্মসূত্রে ২০ বছর যাবৎ থাকেন চট্টগ্রামে। একটি জুয়েলার্সে চাকরি করেন তিনি। রিয়াজউদ্দিন বাজারের রিজওয়ান প্লাজার ছয়তলায় বাসা ভাড়া নিয়ে পরবিারসহ থাকেন রায়হান।

রায়হান বলেন, ‘মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। কল্পনা করতে পারিনি বেঁচে ফিরব। আমার বেঁচে ফেরার চেয়ে চিন্তা ছিল পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। তাদের কীভাবে বাঁচাব, সেটা নিয়ে যুদ্ধ করেছি। এক বছরের শিশু ফোরকান রহমান ও বড় মেয়ে আছিয়া রহমান সুস্থ আছে। স্ত্রী মেহরিনা পারভিন আছেন চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে। ছোট মেয়ে জান্নাতুল আক্তার বার্ন অ্যান্ড সার্জারি ইউনিটের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছে।’

ঘটনার রাতের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন রাতে আমি দেরিতে ঘুমাই। বৃহস্পতিবার রাতে চোখে ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে রাত দেড়টায় ঘুমাতে যাই। হঠাৎ নিচ থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনি। দরজা খুললে বুঝতে পারি ভবনে আগুন লেগেছে। ছোট ছেলে আর দুই মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে বের হওয়ার চেষ্টা করি। ততক্ষণে পুরো রুমে ধোঁয়ায় আছন্ন হয়ে যায়। শ্বাস নিতে পারছি না। বিদ্যুৎও চলে গেছে। আইপিএস চললেও চারদিকে অন্ধকার। মোবাইলের ফ্লাস লাইট জ্বালিয়েও কিছু দেখা যাচ্ছে না।’

রায়হান বলেন, এমন সময় সন্তান আর স্ত্রী মেহরিনার কান্নায় কিছুটা নিস্তব্ধ হয়ে যান তিনি। তবে থমকে যাননি। মুখে কাপড় বেঁধে এক বছরের ছোট ছেলে ফোরকানকে বুকে ও বড় মেয়েকে এক হাত ধরে ছাদে উঠে যান। স্ত্রী আর ছোট মেয়েকে ওপরে উঠতে বলেন। কিন্তু তারা ধোঁয়ার কারণে উঠতে পারেনি। আবার রুমে চলে যায়। তখনও ছোট ছেলে আর বড় মেয়েকে বাঁচাতে যুদ্ধ করেন তিনি।

তিন বলেন, ‘ছাদেও ধোঁয়ার তাপ আসতে থাকে। পরে ছাদ থেকে পাশের একটি ভবনের কার্নিশ বেয়ে অন্য ছাদে চলে যায়। মেয়ে আর ছেলেকে পার করি। ওই মুহূর্তে কীভাবে আমি এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে গেলাম, তা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে এখন। সেখান থেকে ভবনের নিছে নেমে আসি। তখন ছোট ছেলের মুখ দিয়ে ফেনা দেখতে পাই। মুখে তখন আল্লাহ ছাড়া কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না। নিচে লোকজন আমার কোল থেকে ছেলেকে নিয়ে সেবা দিয়ে স্বাভাবিক করে তুলে।’

রায়হান বলেন, তখন তার শরীর কাঁপছিল। পরে স্ত্রী আর ছোট মেয়ের কথা মনে পড়ে। তিনি ধরেই নিয়েছেন তারা হয়তো আর বেঁচে নেই। তবুও মন না মানায় আদরের সন্তান আর স্ত্রীকে বাঁচাতে ওই ভবনে আবার ওঠেন তিনি। এবার ফায়ার সার্ভিদের সদস্যের নিয়ে ৬ তলার বাসাটি ঢুকেন। সেখানে দেখেন স্ত্রী আর মেয়ে পড়ে আছেন। দ্রুত তাদের সেখান থেকে উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তাদের দুইজনের অবস্থা সংকাপন্ন।

চমেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড সার্জারি ইউনিটের কর্তব্যরত চিকিৎসক শ্রেয়া চাকমা আমাদের সময়কে বলেন, ‘দুজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। কণ্ঠনালী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কিছুটা। ২৪ ঘণ্টা অবজারবেশনে রাখা হয়েছে। এরপরে তাদের পরিস্থিতি বলা যাবে।’

উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের পছন্দের শপিং মল রিয়াজ উদ্দিন বাজার। নগরীর জুবলী রোজ ও স্টেশন রোডের মাঝখানে বড়সড়ো জায়গায় গড়ে ওঠা এই বিশাল মার্কেটে শত শত ভবন থাকলেও সবদিক দিয়ে এখানে প্রবেশের পথ অতি সরু। ফলে রিয়াজ উদ্দিন বাজারের ভেতরে কোনো গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না। এ কারণে পুরো এলাকাই সবসময় অগ্নিঝুঁকিতে থাকে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার দিকে নগরীর কোতোয়ালী থানার রিয়াজউদ্দিন বাজারে মোহাম্মদিয়া প্লাজার ব্রাদার্স টেলিকম নামে একটি দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়।

অগুন দ্রুত পাশের রেজওয়ান কমপ্লেক্সেও ছড়িয়ে পড়ে। এতে ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন, মো. রেদোয়ান (৩৫), মো. শাহেদ হোসেন (১৮) ও ইসমাইল হোসেন ইকবাল (১৮)। তিনজনই চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার বাসিন্দা।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক বলেন, প্রায় চার ঘণ্টার চেষ্টায় ভোর সাড়ে ৫টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এর আগে ঘটনাস্থল থেকে প্রথমে একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে দুইজন মারা যান। আগুনের ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তদন্ত করে জানানো যাবে।

এদিকে, অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের পারিবারের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। এ ছাড়া নিহতের পরিবারকে সমবেদনা জানাতে চমেক হাসপাতালে ছুটে যান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। এ সময় দুর্ঘটনায় নিহতদের মরদেহ জরুরি ভিত্তিতে বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তিনি।